মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী :
সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, খৃষ্টান এনজিও ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বিতর্কিত এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিশেষ করে ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহের বিরুদ্ধে যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, তা রীতিমত উদ্বেগ ও আতংকজনক। প্রায় প্রতিদিনই এক শ্রেণীর পত্র-পত্রিকায় হক্কানী উলামায়ে কিরাম ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য, অপ-প্রচার, কুৎসা ও প্রোপাগান্ডা ছেপেই যাচ্ছে বিরামহীনভাবে।
তাদের ভাষায়, ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহে নাকি সন্ত্রাসী, খুনী সৃষ্টি করা হয়। এদের দ্বারা জাতি কোনভাবেই উপকৃত হচ্ছে না। পশ্চাদপদতা, কট্টর গোঁড়ামী ও মৌলবাদী ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন এরা। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, মুক্তসাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টি এবং প্রগতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে এসব মৌলবাদী সম্প্রদায়। নারীর ক্ষমতায়ন, নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা ব্যাহত করার লক্ষ্যে এরা ফতোয়াবাজির আশ্রয় নেয়। ক্বওমী মাদ্রাসা থেকে কেবল ভিক্ষুকই সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে এতে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্রও। এরা বাংলাদেশেও আফগানিস্তানের ন্যায় তালিবানী বিপ্লব সংঘটিত করতে বদ্ধপরিকর।
এভাবে হাজারো কল্পকাহিনী ও মিথ্যাচার ছাপিয়ে এরা সমগ্র দেশকে কলুষিত করছে। উত্তপ্ত করে তুলছে বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদ। এরা কি জানে না ক্বওমী মাদ্রাসার ইতিহাস? কালের কোন সন্ধিক্ষণে জন্ম হয়েছে ‘দরসে নিজামী’র সিলেবাস সমৃদ্ধ বেসরকারী ক্বওমী মাদ্রাসার ধ্যান-ধারণা?
ঔপনিবেশিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি দ্বীন ইসলামের অতন্দ্র প্রহরীরূপে হক্কানী উলামায়ে কিরাম সৃষ্টির লক্ষ্যে তৎকালীন বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের সুচিন্তিত মতামতের সুফসল হচ্ছে ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। বিশেষ করে ইংরেজ বড় লাট লর্ড ম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ হিসেবে এই ক্বওমী মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
ম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থার আসন্ন ফলাফল সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থা এমন একটি শিক্ষিত জাতি গঠনে সক্ষম হবে, যারা শারিরীক অবকাঠামোর দিক দিয়ে ভারতীয় হলেও মনেপ্রাণে বিলেতী তথা পাশ্চাত্য প্রেমী হবে। এবং শুধুমাত্র এই শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা ধর্মীয় ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন হবে।
বলা বাহুল্য, যান্ত্রিক সভ্যতামুখী সিলেবাস ও অব্যাহত সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। যেহেতু লর্ডম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার বালাই নেই, সুতরাং যতই এর প্রসার ঘটছে ততই মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে অশান্তি, অনাচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নোংরামী ও অত্যাচার। ধর্মীয় জ্ঞান ও নৈতিকতা বিবর্জিত তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরাই আজ সমাজের প্রধান সমস্যা।
পক্ষান্তরে ক্বওমী মাদ্রাসায় ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আদর্শ চরিত্রগঠন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, নারীর পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা, সমাজে স্থিতিশীলতা, ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান একটি সুষম জাতি গঠনে ক্বওমী মাদ্রাসার অবদান অনস্বীকার্য।
এই ক্বওমী মাদ্রাসা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে মাওলানা মাহ্মুদুল হাসান দেওবন্দী, মাওলানা হুসাইন আহ্মাদ মাদানী, মাওলানা আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী, মাওলানা শিব্বীর আহ্মদ উসমানী, মাওলানা উবাইদুল্লাহ্ সিন্ধী, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা ইলিয়াস দেহ্লভী, মাওলানা খলিল আহ্মদ সাহারানপুরী, মুফ্তীয়ে আযম মাওলানা ফয়জুল্লাহ্, খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহ্মদ, মাওলানা মামছুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ্ হাফেজ্জী হুযূরের ন্যায় অগণিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ও মাহামনীষীদেরকে। তাঁরা ছিলেন হিদায়াতের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। গোমরাহীর অতলান্তে নিমজ্জিত ব্যক্তিরাপথের দিশা পেত তাঁদের দ্বারা। বিশ্ব মানবতার পারলৌকিক উৎকর্ষ সাধনেই তাঁরা নিয়োজিত ছিলেন না, তাদের ইহলৌকিক তথা পার্থিব জীবনাচারও সংশোধন করে ছিলেন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনায়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর উলামায়ে কিরামকে রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা করতে দেখা গেলেও ১৯৭১ সালে পুনরায় বিভক্তির পর বাংলাদেশের উলামায়ে কিরামগণ দরসে কুরআন, দরসে হাদীসসহ মানুষের পারলৌকিক উৎকর্ষ সাধনেই অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েন। কিছু কিছু উলামায়ে কিরামকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় দেখা গেলেও তাঁদের বৃহত্তর অংশ এ ব্যাপারে মৌনতাবলম্বন করে রয়েছেন। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তাঁদের নেই বল্লেই চলে। সরকারী সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত জনগণের আর্থিক ও নৈতিক সহায়তায় পরিচালিত এসব মাদ্রাসায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ, হত্যা, সন্ত্রাস, সেশনজট সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
এ ধরনের নিরীহ, সচ্চরিত্র, নির্বিবাদী ও দ্বীনের রাহ্বার উলামায়ে কিরামকে যখন প্রশাসন ও তদ্বীয় সহযোগিদের আক্রমণের টার্গেট হতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে হবে যে, এই আক্রমণ ইসলামকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উৎখাত করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী যে নীল নকশার বাস্তবায়ন হচ্ছে তার অংশ বিশেষ। বিশেষ করে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম মহীরূহ, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, যা সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র, তাকেও আক্রমণ থেকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বেশ কয়েকবার গোপনীয় ভাবে তদন্ত করে কিছু না পেলেও একশ্রেণীর পত্র-পত্রিকা আজগুবী সব প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বস্তরের জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
ক্বওমী মাদ্রাসা একটি আদর্শ, একটি চিন্তাধারা, একটি দর্শন, একটি ইতিহাস, একটি বিপ্লব, একটি ইলহামী বিদ্যাপীঠ, হক ও হক্কানিয়্যাতের এক দুর্ভেদ্য দূর্গ এবং হিরার মশাল বহনকারী এক মকতবে ফিক্র। বস্তুতঃ এর মুআল্লিম, মুতাআল্লিম তথা ছাত্র-শিক্ষকগণ হলেন, মা-আনা আলাইহি ওয়াআস্হাবী- “যে পথে আছি আমি (রাসূল) ও আমার সাহাবীগণ আছে”-এর কেতনধারী এক কাফেলা। তাঁরা হলেন, আহ্লুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উসওয়া ও আদর্শের অনুসারী মুজাহিদীনে ইসলামের এক বৈপ্লবিক জামাআত। ইক্বামতে দ্বীনের চেতনাবাহী নিবেদিত প্রাণ আল্লাহ্ ওয়ালা মর্দে মুজাহিদ তৈরী করার এক কারখানা এই ক্বওমী মাদ্রাসা।
এ ক্বওমী মাদ্রাসার প্রাণকেন্দ্র হল ঐতিহাসিক দারুল উলূম দেওবন্দ। এ মাদ্রাসার পরিচয় দিতে গিয়ে এর তদানিন্তন মুহ্তামিম হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী তৈয়ব (রাহ্.) বলেছেন, অর্থাৎ- “আরবাবে মাদারিস তথা এ মাদ্রাসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান, আক্বীদাগত দিক থেকে আহ্লুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত, মাযহাবের দিক থেকে হানাফী, দর্শনের দিক থেকে আশ্আরী ও মাতুরীদি, মাশরাবের দিক থেকে সূফী, তরীকার দিক থেকে চিশ্তী ও নকশবন্দী, চিন্তাধারার দিক থেকে ওয়ালীউল্লাহী, মূলনীতির দিক থেকে কাসেমী, ফুরূআতের দিক থেকে রশীদী, সামগ্রিকতার দিক থেকে মাহ্মূদী এবং কেন্দ্রীয় নিসবতের দিক থেকে দেওবন্দী”।
বস্তুতঃ এটাই ক্বওমী মাদ্রাসার জামে (ব্যাপক) পরিচয়। এ কোন নতুন চিন্তাধারা বা নতুন কোন প্রতিষ্ঠানের নাম নয়। বরং ঈমান, ইসলাম এবং ইহ্সানের এক সমন্বিত শিক্ষাকেন্দ্রের নাম হল ক্বওমী মাদ্রাসা। সাহাবায়ে কিরামের পরিচয় দিতে গিয়ে রোমান গুপ্তচর যে দু’টি কথা তুলে ধরেছিল যে, “তারা হল, ফুরসান ফিন নাহার রূহ্বান ফিল লাইল- রাতে ইলাহী হুযূরে সন্যাসগত আর দিনে অশ্বারোহী সৈনিক”। মূলতঃ এরই প্রতিকৃতি হল এই ক্বওমী মাদ্রাসা। নিম্নে পর্যায়ক্রমে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি।
কেন এ ক্বওমী মাদ্রাসা
ইসলাম এক মুকাম্মাল দ্বীন ও পূর্ণাঙ্গ নিযামে হায়াত। বস্তুতঃ ঈমান, আমল ও ইহ্সানের সমষ্টির নাম দ্বীন। আর অব্যাহত জিহাদ হল এর সর্বোচ্চ চুড়া। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবন ব্যাপী ত্যাগ, সাধনা, কুরবানী ও শ্রমের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার সরাসরি পথ নির্দেশনার আলোকে এরই সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন সাহাবায়ে কিরামের সুমহান জামাআত। তাঁরা হলেন হক ও হক্কানিয়্যাতের মাপকাঠি। তাঁরা ছিলেন হিদায়াতের এমন উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা, যে কেউ তাঁদের অনুসরণ করবে তারা সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যাবে। রিযায়ে ইলাহীর সুউচ্চ শিখরে তাঁদের অধিষ্ঠান। তাঁদের পথ ধরেই গড়ে উঠেছেন তাবিঈন, তাবে তাবিঈন, মুজাদ্দিদীন, মুহাদ্দিসীন, ফুক্বাহা ও সালিহীনের প্রজন্ম পরম্পরায় আকাবিরে উম্মতের এক সুমহান কাফেলা। আকাবিরে উম্মতের সুযোগ্য উত্তরসূরী ঈমানী আলোয় উজ্জীবিত এক মহান ব্যক্তিত্ব হলেন ইমামুল হিন্দ হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ্.)।
শিল্পবিপ্লবের কালে যখন তাগুতীশক্তি বস্তুবাদী দর্শনের উপর ভর করে উন্নয়ন, প্রগতি ও প্রযুক্তির মোহময়তার আবরণে সাম্রাজ্যবাদী দুরাকাঙ্খা পুরণে মত্ত হয়ে উঠে এবং যখন নাস্তিক্যবাদী মানবতা বিরোধী তথাকথিত সমাজকান্ডারী ব্যক্তিরা কমিউনিজমের জয়গান গাইতে আরম্ভ করে, তখন তাদের মুকাবিলায় এগিয়ে এলেন হযরত শাহ্ সাহেব (রাহ্.)। তিনি নববী সুন্নাহ্ ও শিক্ষার আলোকে ইসলামের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সকল বিধিবিধানের বিশ্লেষণ করে পেশ করলেন ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সার্বিক রূপরেখা এবং তাগুতী শক্তিকে রুখবার এক কার্যকর ব্যবস্থা। গড়ে উঠল হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয, হযরত শাহ্ ইসমাঈল শহীদ, হযরত সায়্যিদ আহ্মদ শহীদ ও হযরত মাওলানা আব্দুল হাই (রাহ্.) প্রমুখের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী জামাআত। বালাকোটের প্রান্তরে রক্ত আখরে লেখা হল তাঁদের নাম। পরবর্তীতে এ ধারারই এক মহাপুরুষ হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কী (রাহ্.) নেতৃত্ব দেন সিপাহী বিদ্রোহ নামে প্রসিদ্ধ এই আযাদী আন্দোলনের।
১৮৫৭ সালের সিপাহী জনতার স্বাধীনতা আন্দোলন আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়ার পর উপমাহাদেশের উপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের দখলকে আরো সুসংহত করে নেয়। নেমে আসে নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম নেতা এবং উলামায়ে কিরামের উপর অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন। এতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। হাজারো মানুষ হয় কালাপানির নিঃসহ অত্যাচারের শিকার। চট্টগ্রাম থেকে খায়বার পর্যন্ত গ্রান্ড ট্রাংক রোডের দু’পাশের একটি বৃক্ষশাখাও এমন ছিলনা, যার মাঝে ঝুলছিলনা কোন শহীদের লাশ। ইংরেজ বেনিয়ার গোষ্ঠী মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনাকে খতম করে দেওয়ার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়। এহেন অবস্থায় চরম হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে ইসলাম প্রিয় জনতা।
চারিদিকে তখন ভীষণ দুর্দিন। স্যার সৈয়দ আহ্মদের নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলন নামে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের তোষন ও আপোষকামিতার সবক পড়ানো হচ্ছিল তখন। সে এক দুর্যোগময় মুহুর্তে এগিয়ে এলেন ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত, ওয়ালীউল্লাহী ফিক্রের আলম বরদার, উম্মতের কল্যাণ চিন্তায় দগ্ধ হৃদয়ের অধিকারী, কাসিমুল উলূম ওয়াল খাইরাত, হুজ্জাতুল ইসলাম, হযরত কাসিম নানুতুবী (রাহ্.) ও ফক্বীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
পৃথিবীর সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র ও আক্রমণসমূহের পূর্বাপর পর্যালোচনা করে নববী তা’লীম ও শিক্ষার আলোকে ইসলামী পুনঃজাগরণ এবং সংস্কারের এক সার্বিক ও কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণ করলেন তাঁরা। এরই প্রেক্ষিতে ১৮৬৭ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ইসলহামী প্রতিষ্ঠান। যার নাম দারুল উলূম দেওবন্দ।
দারুল উলূম দেওবন্দ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়। বরং কুরআন-হাদীসের নিরিখে নববী আলোয় গড়া ইসলামী মত ও পথের একটি মানবতাবাদী বিপ্লবী বিশ্বকেন্দ্র। মুক্তিকামী মানুষের প্রয়োজনে এমন কোন ডাক নেই এবং এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে নেতৃত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখেনি এই দারুল উলূম দেওবন্দ। এ প্রতিষ্ঠানটি বিনির্মাণে যে সমস্ত আকাবির হযরত নানুতুবী (রাহ্.)কে সাহায্য করেছেন তাঁরা হলেন, হাজী আবিদ হুসাইন, মাওলানা যুলফিকার আলী, মাওলানা ফযলুর রহ্মান, মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবী ও মাওলানা রফীউদ্দীন (রাহ্.)। প্রতিষ্ঠাতা হযরত নানুতুবী (রাহ্.)সহ তাঁদের সকলকে এক কথায় আকাবিরে সিত্তাহ্ বা ছয় মুরুব্বী বলা হয়।
দারুল উলূম দেওবন্দ এক ইলহামী বিদ্যাপীঠ
দারুল উলূম দেওবন্দ ঘটা করে প্রতিষ্ঠিত কোন প্রতিষ্ঠান নয়। বরং এ হচ্ছে এক ইলহামী বিদ্যাপীঠ। এর ভিত্তি ইলহামী, মূলনীতি ইলহামী, স্থান নির্বাচন ইলহামী, ইমারত নির্মাণ ইলহামী, এমনকি ছাত্রের ভর্তি এবং দাখেলাও ইলহামী।
“তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দ” গ্রন্থের ভূমিকায় একথা উল্লেখ আছে যে, আকাবিরে সিত্তাহ্ পরস্পর পরামর্শ করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর একে অপরকে বলতে লাগলেন, এরূপ প্রতিষ্ঠান বানানোর প্রয়োজনীয়তা আমি দীর্ঘ দিন যাবত অনুভব করে আসছিলাম, কেউ বল্লেন, স্বপ্নে আমাকে এরূপ দেখানো হয়েছিল।
আবার কেউ বল্লেন, কাশফের মাধ্যমে আমিও এমনটি অনুভব করেছিলাম। এতে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, এ ক্বওমী মাদ্রাসা হচ্ছে খালিস ইলহামী মাদ্রাসা। শুধু তাই নয়, পূর্বেকার বুযুর্গানে দ্বীন থেকেও অনুরূপ ইশারা বিদ্যমান রয়েছে। একদা হযরত সায়্যিদ আহ্মদ শহীদ (রাহ্.) দেওবন্দ এলাকা হয়ে সীমান্ত প্রদেশের দিকে যাচ্ছিলেন। মাদ্রাসার এ স্থানটিতে পৌঁছার পর তিনি বলছিলেন, “এ স্থান থেকে আমি ইল্মের সুঘ্রাণ পাচ্ছি”।
এমনিভাবে এর ইমারতও ইলহামী। মাদ্রাসার প্রথম ইমারত তথা নওদারার ভিত্তি স্থাপনের সময় মাটি কেটে নির্ধারিত স্থানে ভিত্তি রাখা হয়। ঐদিন রাত্রেই মুহ্তামিম হযরত মাওলানা শাহ্ রফী উদ্দীন (রাহ্.) স্বপ্নে দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশ্রীফ এনেছেন এবং তিনি তাঁকে বলেন, পূর্বের জায়গা যথেষ্ট নয়, এ স্থানে ভিত্তিস্থাপন কর। ভোরে তিনি ঐ স্থানে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লাঠি মুবারকের স্পষ্ট দাগ দেখতে পান।
অনুরূপ এর ছাত্র ভর্তিও ইলহামী। বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত মাওলানা শাহ্ রফীউদ্দীন (রাহ্.) মৌলসরী এলাকায় দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে কয়েকজন ছাত্র। এমতাবস্থায় দাওরা হাদীসের একজন ছাত্র বোর্ডিং ঘর থেকে খানা এনে হযরত মুহ্তামিম সাহেব (রাহ্.)-এর সামনে তরকারীর পেয়ালাটি নিক্ষেপ করতঃ বল্ল, “এই নিন আপনার ইহ্তিমাম। ডালে শুধু পানি আর পানি। এতে না আছে ঘি, আর না আছে মসলা।” সাথে আরো দু’চারটি কটুবাক্য। হযরত তাকে কিছু না বলে তার মাথা হতে পা পর্যন্ত তিনবার নজর করে বললেন, এ দারুল উলূমের ছাত্র নয়। এতে উপস্থিত ছাত্রদের মনে কৌতুহল জাগল।
তারা নাছোড় বান্দা হয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বল্লেন, একদা আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, মৌলসরী এলাকার কূপটি দুধে ভরপুর। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কূপটির পাড়ে দাঁড়িয়ে দুধ বন্টন করছেন। অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন পাত্রে করে দুধ নিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন দুধ গ্রহণকারীদের মধ্যে এই ছাত্রটিকে আমি দেখতে পাইনি। অতঃপর মুরাকাবার অবস্থায় আমার এ মর্মে কাশ্ফ হল যে, কুয়া দ্বারা দেওবন্দ মাদ্রাসা, দুধ দ্বারা ইল্ম এবং দুধ গ্রহণকারীদের দ্বারা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে বুঝানো হয়েছ। সুতরাং সে এই মাদ্রাসার ছাত্র হতে পারে না।
মা-আনা আলাইহি ওয়া আসহাবীর অনুসারী এ কাফেলা
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে তিয়াত্তরটি দল হবে। একটি দল ব্যতীত সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তারা কারা? উত্তরে তিনি বল্লেন, “মা-আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী- যে পথে আছি আমি ও আমার সাহাবীগণ”। এরই বাস্তব নমুনা হল এই ক্বওমী মাদ্রাসা। কেননা মা-আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী মানে সুন্নাত ও জামাআত। যাকে আমরা “আহ্লুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআত” বলে জানি।
আকাবিরে ক্বওমী মাদ্রাসা এ জামাআতের পথ ও মত থেকে এক চুল পরিমাণও বিচ্যুত হননি জীবনের কোন অধ্যায়ে। তাঁরা কুরআন-সুন্নাহকে গ্রহণ করেছেন রিজাল এর ব্যাখ্যার আলোকে। আর রিজালকে গ্রহণ করেছেন কুরআন-সুন্নাহর মাপকাঠিতে। কুরআন-সুন্নাহ্কে বাদ দিয়ে তাঁরা যেমনিভাবে রিজাল পুরুস্তীতে ডুবে যাননি এমনিভাবে তাঁরা রিজালকে বাদ দিয়ে কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কোনরূপ তাহ্রীফ, তা’বীল এবং ইন্তিহালের চোরাপথও উন্মোচন করেননি।
তারা জানেন, আকাবির তথা রিজালের ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান ও সবক হাসিল করাকেই হক বলা হয়। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ্ পরিপন্থী জ্ঞান এবং নিজের মনগড়া ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন ও সুন্নাহর সমঝকেই বাতিল বলা হয়। তাই তাঁরা কোন অবস্থাতেই ইফ্রাত-তাফ্রীত তথা প্রান্তিকতার শিকার হননি। বরং তারা সর্বদাই এতদুভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছেন। কাজেই আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে একথা বলতে পারি যে, ক্বওমী মাদ্রাসা হচ্ছে “উম্মাতাও ওয়াসাতান” মধ্যপন্থী- প্রান্তিকতাহীন উম্মত গড়বার এক ইলাহী কেন্দ্রভূমি।
এ নীতির সফল বাস্তবায়ন ঘটেছে এখানকার ছাত্র শিক্ষক সকলের মাঝে সর্বোতভাবে। তাই তাঁরা যেমনিভাবে আবেগ ও ইশ্ক বিবর্জিত নজদী নয়, অনুরূপভাবে আক্ল ও যুক্তি বিবর্জিত আবেগপ্রবণ ইশ্ক পূজারী ওয়াজদীও নয়। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা খলীল আহ্মদ সাহারানপুরী (রাহ্.)কে নজদীদের সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আকলের সাথে ইশ্ক আর ইশ্কের সাথে আকল এতদুভয়ের সমন্বয়ের মাঝেই রয়েছে হক তথা মহাসত্য। এরই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্বওমী মাদ্রাসার ভিত্তিভূমি দারুল উলূম দেওবন্দ।
উলূম ও ফুনূনের এক সমন্বিত শিক্ষাকেন্দ্র এ ক্বওমী মাদ্রাসা
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বর্ণযুগে সাহাবাগণ তাঁর সুহ্বতে এসে ইল্ম হাসিল করতেন। তাঁরা যা শিখতেন সে মুতাবেক আমল করতেন এবং নববী আখলাকের আলোকে নিজেদেরকে করে তুলতেন পরিশোধিত ও সুশোভিত। প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবার ছিল ঈমান, আমল ও ইহ্সানের সমন্বিত এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রিবাত ও খানকাভূমি। তাই দরবারে নবুওয়াতের ছাত্র সাহাবায়ে কিরাম এ দিকে যেমন কুরআনের ক্বারী ছিলেন। তেমনিভাবে তাঁরা কুরআনের হাফেজ, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, মুজাহিদ এবং শাইখে তরীকতও ছিলেন।
পরবর্তীকালে সমাজ বিবর্তনের পাশাপাশি উলূমে ইসলামিয়ার সাথে বিভিন্ন উলূম ও ফুনূনের সংযোজন হতে থাকে। উলূমে শরঈয়্যার সাথে উলূমে আক্বলিয়্যা এবং উলূমে আলিয়া তথা বহু সহায়ক উলূম এর সাথে সংযোজন করা হয়। কালক্রমে উলূমে নক্বলিয়্যার উপর উলূমে আক্বলিয়্যা দারুণভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে নেয়। এতে উলূমে নক্বলিয়্যার শিক্ষাক্ষেত্রে এক মন্দাভাব পরিলক্ষিত হয়। ঈমানী নূরে উদ্ভাসিত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (রাহ্.)এর হৃদয়ে তা দারুণভাবে রেখাপাত করে। তাই তিনি হাদীস ও তাফ্সীরের শিক্ষাকে অন্যান্য শিক্ষার উপর প্রাধান্য দেওয়া এবং বস্তুবাদের ব্যাপক হামলা থেকে দ্বীন ও ঈমানকে রক্ষা করার লক্ষ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন কারিকুলাম আবিষ্কার করেন এবং আক্বল ও যুক্তির আলোকে কুরআন ও সুন্নাহ্কে জনসমক্ষে তুলে ধরতে উদ্যোগী হন।
এতদুপলক্ষ্যে যুক্তিপূর্ণ তা’লীমের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন গ্রন্থও রচনা করেন। যুগের পরিবর্তনের সাথে নতুন নতুন দাবীও সংযোজিত হতে থাকে। তাই ওয়ালীউল্লাহী চিন্তাধারার যোগ্য উত্তরসূরী হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল গনী মুজাদ্দিদী (রাহ্.) ভাবলেন যে, শুধু যৌক্তিকভাবেই নয় বরং মাহ্সূসাতের মাধ্যমে দ্বীনের ব্যাখ্যা পেশ করা না গেলে দ্বীন ও ঈমানের এ সৌধটি মারাÍক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। তাই তিনি এর সাথে আরেকটি নতুন ধারার সংযোজন করেন।
পরবর্তীকালে বস্তুবাদের ফিত্না আরো মারাÍক আকার ধারণ করলে আকাবিরের যোগ্য উত্তরসূরী কাসিমুল উলূমি ওয়াল আইরাত হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ্.) এ কথা উপলব্ধি করলেন যে, এখন দ্বীনকে হিস্সিয়্যাত ও বদ্হিয়্যাত এর মাধ্যমে পেশ করতে হবে।
এ পর্যায়ে এসে দ্বীনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন ধারা সংযোজিত হয়। উসূল ঠিক রেখে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নতুন ধারা সংযোজনের এ সিলসিলায় পক্ষপাতমূলক চিন্তাধারা সর্বদাই পরিহার করা হয়েছে অত্যন্ত সচেতনতা ও বিচক্ষণতার সাথে। এখানে ইল্ম থেকে আমলকে পৃথক করে দেখা হয়নি কখনো। বরং ইল্মের সাথে আমল এবং আখলাকের সাথে রূহানিয়্যাতের প্রশিক্ষণ এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে নিয়মিতভাবে।
এ শিক্ষা ধারার বৈশিষ্ট হল, নকলের সাথে আক্বল, আক্বলের সাথে অনুভূতি এবং অনুভূতির সাথে দলীলে বদহীর সমন্বয় সাধন। এমনিভাবে ইল্মের সাথে মা’রিফাত, হুকুমের সাথে হিকমত, মা’ক্বুলের সাথে মাহ্সূস, ক্বানূনের সাথে মুসলিহাত, শরীয়তের সাথে তরীক্বত, ঈমানের সাথে ইহ্সান এবং আত্মরক্ষার সাথে আক্রমণ তথা সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থাই এ ক্বওমী মাদ্রাসার অন্যতম বৈশিষ্ট। এরই ফলশ্রুতিতে আক্বাঈদ ও বিশ্বাস, আখলাক ও নৈতিকতা, তা’লীম ও তাদ্রীস, তরবিয়্যাত ও প্রশিক্ষণ, তাস্নীফ ও তালীফ, দাওয়াত ও তাবলীগ, ইহ্সান ও তাযকিয়া, দাওয়াত ও জিহাদ, রাজনীতি ও অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, এক কথায় মানব কল্যাণকামিতা ও উসওয়ায়ে নবুওয়াতের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে এই ক্বওমী মাদ্রাসার সূর্য সন্তানদের নেতৃস্থানীয় সরব উপস্থিতি ও অবদান নেই।
আধ্যাত্মিক রাহ্নুমায়ীর প্রাণকেন্দ্র এ ক্বওমী মাদ্রাসা
তাহ্যীবুল আখলাক, তাযকিয়ায়ে বাতিন তথা আত্মশুদ্ধিই হল দ্বীনি কাজের মূল নিয়ামক বা চালিকাশক্তি। কেননা, তাহ্যীবুল আখলাক মানে নিজেকে আখলাকে রযীলা তথা কিনা, রিয়া, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা, পরশ্রিকাতরতা, গীবত, চোগলখোরী, ধোঁকা-প্রতারণা, মিথ্যা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ইত্যাদি হতে পাক সাফ করে আখলাকে হামীদা তথা সততা, আমানতদারী, অঙ্গীকার রক্ষা করণ, অন্যের প্রতি ভাল ধারণা পোষণ, অন্যের কল্যাণকামনা, ইখলাস, লিল্লাহিয়্যাত, নামাযে খুশুখুযু হাসিল করণ, সেহেরগাহী আদায় করে রোনাযারী করণ, নফ্সের মুহাসাবা ও জায়েযা গ্রহণ ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত করা।
এটা আখলাক বা আত্মশুদ্ধির মূল কথা। হাদীসে জিব্রাঈলে একেই ইহ্সান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একথা অস্বীকার করার জো নেই। এ সূত্র ধরেই ইমামুত্ তরীক্বত শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী, শাইখ শিহাব উদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী, হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী, শাইখ মুঈনুদ্দীন চিশ্তী, হযরত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহ্লভী এবং হযরত সায়্যিদ আহ্মদ শহীদ (রাহ্.) প্রমুখ বুযুর্গানে দ্বীন নিজ নিজ যুগে মুসলিম উম্মাহ্কে আধ্যাত্মিক রাহ্নুমায়ী করেছেন।
পরবর্তীকালে আকাবিরে ক্বওমী মাদ্রাসার হযরত কাসেম নানুতুবী, ফক্বীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহ্মদ গাঙ্গুহী, হাকীমুল ইম্মত হযরত মাওলানা আশ্রাফ আলী থানভী, শাইখুল আরব ওয়াল আযম শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহ্মদ মাদানী, মাওলানা সাঈদ আহ্মদ সন্দ্বীপী, মুফ্তিয়ে আযম হযরত মাওলান ফয়যুল্লাহ্, মাওলানা শামছুল হক্ ফরিদপুরী, মাওলানা আত্হার আলী, শাইখে বাঘা (রাহ.) প্রমুখ মাশাইখে কিরাম এ ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন। তাঁদের এ মেহনতের বদৌলতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, আফ্রিকা, আমেরিকা, ইউরোপ প্রভৃতি দেশে লক্ষ লক্ষ আল্লাহ্ প্রেমিক ইলাহী প্রেমে মত্ত হয়ে আল্লাহু আল্লাহু শব্দের গুঞ্জরণে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছে। এ পর্যায়ে ক্বওমী মাদ্রাসার ভূমিকা স্মরণীয়।
হযরত থানভী (রাহ্.) বলেন, পূর্বে তাসাউফের ক্ষেত্রে পূর্ণতা অর্জন না করা ব্যতীত দাওরা ফারিগ কোন ছাত্রকে সনদ প্রদান করা হত না। এসব মাদ্রাসা সমূহে তাসাউফের বিষয়টি সর্বদাই সযতেœ লালিত হয়ে আসছে। ইল্মের সাথে আমল, আমলের সাথে রূহানিয়্যাতের অন্যতম লালনক্ষেত্র এ ক্বওমী মাদ্রাসা। হযরত শাইখুল হিন্দ (রাহ্.) মাদারে ইল্মী দারুল উলূম দেওবন্দ সম্বন্ধে বলেছেন, “দিনের বেলায় দারুল উলূমকে দেখা যেত যাহিরী ইল্ম চর্চার এক শিক্ষাকেন্দ্র রূপে। আর রাতের বেলা দেখা যেত একে খানকাভূমি হিসেবে”। বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়ের যে ধ্বস নেমেছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য এ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই।
দ্বীনের বলিষ্ঠ দূর্গ এ ক্বওমী মাদ্রাসা
ইসলাম ক্বিয়ামত পর্যন্তের জন্য আল্লাহর মনোনীত দ্বীন। তিনি নিজেই এর হিফাযতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- “আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক”। এ অঙ্গীকারের ফলশ্রুতিতে যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে যুগে যুগে আল্লাহ্ তায়ালা এমন এমন রিজাল এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যারা দ্বীনের ইশাআত ও প্রচারের পাশাপাশি এ দ্বীনকে সর্বপ্রকার ভ্রান্তি, বাড়াবাড়ি ও হামলা থেকে হিফাযত করেছেন।
এ ধারারই উত্তরসূরী হলেন, আকাবিরে ক্বওমী মাদ্রাসা। হিফাযতে দ্বীনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, এমন কোন শাখা নেই যেখানে আমাদের আসলাফ ও আকাবিরের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল না। ইসলাম ও মুসলমানদের উপর যেখানেই আক্রমণ হয়েছে সেখানেই তারা ব্যাঘ্রের ন্যায় বজ্র কঠিন হুংকার দিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং ইসলামের দুশমনদের সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছেন। শিখদের চক্রান্ত, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ছলচাতুরী, আরিয়া সমাজ ও আর্যদের ফিত্নাসহ শিয়া, কাদিয়ানী, বিদ্আতী, মওদুদী, আলীগড়ী, নায়চারী, মাহ্দূবী, বাহাঈ তথা সর্বপ্রকারের ফিত্নার মুকাবেলায় আমাদের আকাবির ও বুযূর্গানে দ্বীন মুনাজারা ও কলমী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং হক্কে হক্ আর বাতিলকে বাতিল হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন পরিস্কারভাবে। রাজ্যহারা মুসলমানদেরকে খ্রীস্টান বানানোর লক্ষ্যে ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্যত হলে এগিয়ে আসেন মাওলানা রহ্মাতুল্লাহ্ কিরানভী (রাহ্.)সহ তাঁর আরো কতিপয় সহযোদ্ধা। মুকাবেলা হয় পাদ্রী ফান্ডারের সাথে। পরাজিত হয়ে পাদ্রী ফান্ডার রাতের অন্ধকারে হিন্দুস্তান ছেড়ে পলায়ন করে। এমনি আরো বহু ঘটনা।
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতীয় এ উপমহাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যে আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে, তাতেও ওয়ালীউল্লাহী চিন্তাধারার মানষপুত্র ক্বওমী মাদ্রাসার উলামাদের ভূমিকা অসামান্য। বরং এ ক্ষেত্রেও তারা অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। জান দিয়েছেন, মাল দিয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন, বাড়ি-ঘর লুট হয়েছে তথাপিও দেশকে তারা আযাদ করেছেন। ঐতিহাসিক মাল্টা, করাচী ও নৈতিতাল কারাগার আজও তাদের সেই রক্তাক্ত ইতিহাসকে বক্ষে ধারণ করে আছে। ঐতিহাসিক রেশ্মী রুমাল আন্দোলনের কথা দেশবাসী কখনো ভুলতে পারবে না।
বস্তুতঃ এক চুড়ান্ত জিহাদের লক্ষ্যেই এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আযাদী আন্দোলনের সূর্য সন্তান মাদারে ইল্মী দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র হযরত শাইখুলহিন্দ (রাহ্.) বলেন, “হযরত নানুতুবী (রাহ্.) কি এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু দরস-তাদরীস, তা’লীম-তাআল্লুম তথা শুধু পাঠ দেওয়া এবং পাঠগ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন? মাদ্রাসা তো আমার সামনে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমার জানা মতে এ প্রতিষ্ঠানটি ১৮৫৭ সালের আপাতঃ ব্যর্থতার পর কায়েম করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল, এমন কোন কেন্দ্র কায়েম করা; যার তত্ত্বাবধানে ১৮৫৭ সালের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ফেলে কাঙ্খিত বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য লোকদেরকে তৈরী করা হবে। তিনি আরো বলেন, শুধু দরস্-তদ্রীস এবং তা’লীম-তাআল্লুম যাদের উদ্দেশ্য আমি তাদের পথে বাধা হবো না। কিন্তু আমি তো আমার জন্য ঐ পথই বেছে নিয়েছি যার জন্য শ্রদ্ধেয় উস্তাদ দারুল উলূমের এ ব্যবস্থাপনার ইন্তিজাম করেছেন”।
প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই দারুল উলূম এ ব্যাপারে সচেতন ছিল এবং জিহাদী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এরই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার সূর্য তাঁরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন। তৎকালে আকাবিরের এ আন্দোলন না হলে ভারত স্বাধীন হত না, পাকিস্তান হত না এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশেরও অভ্যূদয় ঘটত না।
ক্বওমী মাদ্রাসার ক্রমবিকাশের ধারা
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুফ্ফায় তা’লীমী যে সিলসিলা জারী করেছিলেন, এর প্রচলিত রূপই এ ক্বওমী মাদ্রাসা। ১৮৬৭ সনে ঐতিহাসিক ডালিম বৃক্ষের নীচে প্রতিষ্ঠিত হয় এ মাদ্রাসা। আমি পূর্বে এ কথা উল্লেখ করেছি যে, এটা ঘটা করে স্থাপিত কোন প্রতিষ্ঠান নয়। বরং এ জাতীয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা তৎকালীন বুযুর্গানে দ্বীনের অনেকেরই কাশ্ফ ছিল। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বর্তমানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া দ্বীনের হিফাযত সম্ভব নয়। তাই তারা বিপুল পরিমাণে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিন্তা ভাবনা অব্যাহত রাখেন।
এরই ফলশ্রুতিতে ছয় মাস পর দারুল উলূমের নিসাব, আদর্শ, কর্মনীতি ও এর পৃষ্ঠপোষকতায় সাহারানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় “মুজাহিরুল উলূম মাদ্রাসা”। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্থানে তথা মীরাঠ, কানপুর, থানাভবন, মুরাদাবাদ প্রভৃতি স্থানে আরো মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে দারুল উলূম থেকে উত্তীর্ণ আলিমগণ শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে-বিদেশে এই কারিকুলামের অনুসরণে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার তৎপরতা শুরু করেন। ফলে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে অসংখ্য ক্বওমী মাদ্রাসা গড়ে উঠে। ১৯৩৭ সনের পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায় যে, তখন কেবল ভারতেই এ পদ্ধতির অন্ততঃ এক সহ¯্র দ্বীনি মাদ্রাসা ছিল।
১৯৭১ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশেও এ জাতীয় বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ক্বওমী মাদ্রাসা হল, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ দেশে প্রায় ৪৪৩টি ক্বওমী মাদ্রাসা ছিল। তন্মধ্যে প্রায় ৫১টি ছিল দাওরায়ে হাদীস মাদ্রাসা। বর্তমানে ছোট বড় ক্বওমী মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় চার হাজারেরও অধিক। উপমহাদেশের বাইরেও এ তৎপরতা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি মক্কা-মদীনায় পর্যন্ত এ তৎপরতা বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছে। এসব কিছুই আমাদের আকাবির ও আসলাফের অবদান।
আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সকলকে ক্বওমী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা ও এ ধারাবাহিকতার প্রসারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে দ্বীনের হিফাযতে আত্মনিয়োগ করার তাওফীক দান করেন এবং সর্বপ্রকার গুমরাহী থেকে হিফাযত করেন। পরিশেষে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
“তাঁরাই মোদের পূর্বসূরী
যাঁদের নিয়ে গর্ব করি
কোন্ মুখেতে বড়াই কর
নাও তো দেখি তাঁদের জুড়ি?”
সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, খৃষ্টান এনজিও ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বিতর্কিত এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিশেষ করে ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহের বিরুদ্ধে যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, তা রীতিমত উদ্বেগ ও আতংকজনক। প্রায় প্রতিদিনই এক শ্রেণীর পত্র-পত্রিকায় হক্কানী উলামায়ে কিরাম ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য, অপ-প্রচার, কুৎসা ও প্রোপাগান্ডা ছেপেই যাচ্ছে বিরামহীনভাবে।
তাদের ভাষায়, ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহে নাকি সন্ত্রাসী, খুনী সৃষ্টি করা হয়। এদের দ্বারা জাতি কোনভাবেই উপকৃত হচ্ছে না। পশ্চাদপদতা, কট্টর গোঁড়ামী ও মৌলবাদী ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন এরা। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, মুক্তসাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টি এবং প্রগতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে এসব মৌলবাদী সম্প্রদায়। নারীর ক্ষমতায়ন, নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা ব্যাহত করার লক্ষ্যে এরা ফতোয়াবাজির আশ্রয় নেয়। ক্বওমী মাদ্রাসা থেকে কেবল ভিক্ষুকই সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে এতে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্রও। এরা বাংলাদেশেও আফগানিস্তানের ন্যায় তালিবানী বিপ্লব সংঘটিত করতে বদ্ধপরিকর।
এভাবে হাজারো কল্পকাহিনী ও মিথ্যাচার ছাপিয়ে এরা সমগ্র দেশকে কলুষিত করছে। উত্তপ্ত করে তুলছে বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদ। এরা কি জানে না ক্বওমী মাদ্রাসার ইতিহাস? কালের কোন সন্ধিক্ষণে জন্ম হয়েছে ‘দরসে নিজামী’র সিলেবাস সমৃদ্ধ বেসরকারী ক্বওমী মাদ্রাসার ধ্যান-ধারণা?
ঔপনিবেশিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি দ্বীন ইসলামের অতন্দ্র প্রহরীরূপে হক্কানী উলামায়ে কিরাম সৃষ্টির লক্ষ্যে তৎকালীন বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের সুচিন্তিত মতামতের সুফসল হচ্ছে ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। বিশেষ করে ইংরেজ বড় লাট লর্ড ম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ হিসেবে এই ক্বওমী মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
ম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থার আসন্ন ফলাফল সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থা এমন একটি শিক্ষিত জাতি গঠনে সক্ষম হবে, যারা শারিরীক অবকাঠামোর দিক দিয়ে ভারতীয় হলেও মনেপ্রাণে বিলেতী তথা পাশ্চাত্য প্রেমী হবে। এবং শুধুমাত্র এই শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা ধর্মীয় ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন হবে।
বলা বাহুল্য, যান্ত্রিক সভ্যতামুখী সিলেবাস ও অব্যাহত সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। যেহেতু লর্ডম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার বালাই নেই, সুতরাং যতই এর প্রসার ঘটছে ততই মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে অশান্তি, অনাচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নোংরামী ও অত্যাচার। ধর্মীয় জ্ঞান ও নৈতিকতা বিবর্জিত তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরাই আজ সমাজের প্রধান সমস্যা।
পক্ষান্তরে ক্বওমী মাদ্রাসায় ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আদর্শ চরিত্রগঠন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, নারীর পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা, সমাজে স্থিতিশীলতা, ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান একটি সুষম জাতি গঠনে ক্বওমী মাদ্রাসার অবদান অনস্বীকার্য।
এই ক্বওমী মাদ্রাসা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে মাওলানা মাহ্মুদুল হাসান দেওবন্দী, মাওলানা হুসাইন আহ্মাদ মাদানী, মাওলানা আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী, মাওলানা শিব্বীর আহ্মদ উসমানী, মাওলানা উবাইদুল্লাহ্ সিন্ধী, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা ইলিয়াস দেহ্লভী, মাওলানা খলিল আহ্মদ সাহারানপুরী, মুফ্তীয়ে আযম মাওলানা ফয়জুল্লাহ্, খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহ্মদ, মাওলানা মামছুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ্ হাফেজ্জী হুযূরের ন্যায় অগণিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ও মাহামনীষীদেরকে। তাঁরা ছিলেন হিদায়াতের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। গোমরাহীর অতলান্তে নিমজ্জিত ব্যক্তিরাপথের দিশা পেত তাঁদের দ্বারা। বিশ্ব মানবতার পারলৌকিক উৎকর্ষ সাধনেই তাঁরা নিয়োজিত ছিলেন না, তাদের ইহলৌকিক তথা পার্থিব জীবনাচারও সংশোধন করে ছিলেন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনায়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর উলামায়ে কিরামকে রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা করতে দেখা গেলেও ১৯৭১ সালে পুনরায় বিভক্তির পর বাংলাদেশের উলামায়ে কিরামগণ দরসে কুরআন, দরসে হাদীসসহ মানুষের পারলৌকিক উৎকর্ষ সাধনেই অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েন। কিছু কিছু উলামায়ে কিরামকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় দেখা গেলেও তাঁদের বৃহত্তর অংশ এ ব্যাপারে মৌনতাবলম্বন করে রয়েছেন। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তাঁদের নেই বল্লেই চলে। সরকারী সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত জনগণের আর্থিক ও নৈতিক সহায়তায় পরিচালিত এসব মাদ্রাসায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ, হত্যা, সন্ত্রাস, সেশনজট সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
এ ধরনের নিরীহ, সচ্চরিত্র, নির্বিবাদী ও দ্বীনের রাহ্বার উলামায়ে কিরামকে যখন প্রশাসন ও তদ্বীয় সহযোগিদের আক্রমণের টার্গেট হতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে হবে যে, এই আক্রমণ ইসলামকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উৎখাত করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী যে নীল নকশার বাস্তবায়ন হচ্ছে তার অংশ বিশেষ। বিশেষ করে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম মহীরূহ, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, যা সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র, তাকেও আক্রমণ থেকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বেশ কয়েকবার গোপনীয় ভাবে তদন্ত করে কিছু না পেলেও একশ্রেণীর পত্র-পত্রিকা আজগুবী সব প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বস্তরের জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
ক্বওমী মাদ্রাসা একটি আদর্শ, একটি চিন্তাধারা, একটি দর্শন, একটি ইতিহাস, একটি বিপ্লব, একটি ইলহামী বিদ্যাপীঠ, হক ও হক্কানিয়্যাতের এক দুর্ভেদ্য দূর্গ এবং হিরার মশাল বহনকারী এক মকতবে ফিক্র। বস্তুতঃ এর মুআল্লিম, মুতাআল্লিম তথা ছাত্র-শিক্ষকগণ হলেন, মা-আনা আলাইহি ওয়াআস্হাবী- “যে পথে আছি আমি (রাসূল) ও আমার সাহাবীগণ আছে”-এর কেতনধারী এক কাফেলা। তাঁরা হলেন, আহ্লুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উসওয়া ও আদর্শের অনুসারী মুজাহিদীনে ইসলামের এক বৈপ্লবিক জামাআত। ইক্বামতে দ্বীনের চেতনাবাহী নিবেদিত প্রাণ আল্লাহ্ ওয়ালা মর্দে মুজাহিদ তৈরী করার এক কারখানা এই ক্বওমী মাদ্রাসা।
এ ক্বওমী মাদ্রাসার প্রাণকেন্দ্র হল ঐতিহাসিক দারুল উলূম দেওবন্দ। এ মাদ্রাসার পরিচয় দিতে গিয়ে এর তদানিন্তন মুহ্তামিম হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী তৈয়ব (রাহ্.) বলেছেন, অর্থাৎ- “আরবাবে মাদারিস তথা এ মাদ্রাসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান, আক্বীদাগত দিক থেকে আহ্লুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত, মাযহাবের দিক থেকে হানাফী, দর্শনের দিক থেকে আশ্আরী ও মাতুরীদি, মাশরাবের দিক থেকে সূফী, তরীকার দিক থেকে চিশ্তী ও নকশবন্দী, চিন্তাধারার দিক থেকে ওয়ালীউল্লাহী, মূলনীতির দিক থেকে কাসেমী, ফুরূআতের দিক থেকে রশীদী, সামগ্রিকতার দিক থেকে মাহ্মূদী এবং কেন্দ্রীয় নিসবতের দিক থেকে দেওবন্দী”।
বস্তুতঃ এটাই ক্বওমী মাদ্রাসার জামে (ব্যাপক) পরিচয়। এ কোন নতুন চিন্তাধারা বা নতুন কোন প্রতিষ্ঠানের নাম নয়। বরং ঈমান, ইসলাম এবং ইহ্সানের এক সমন্বিত শিক্ষাকেন্দ্রের নাম হল ক্বওমী মাদ্রাসা। সাহাবায়ে কিরামের পরিচয় দিতে গিয়ে রোমান গুপ্তচর যে দু’টি কথা তুলে ধরেছিল যে, “তারা হল, ফুরসান ফিন নাহার রূহ্বান ফিল লাইল- রাতে ইলাহী হুযূরে সন্যাসগত আর দিনে অশ্বারোহী সৈনিক”। মূলতঃ এরই প্রতিকৃতি হল এই ক্বওমী মাদ্রাসা। নিম্নে পর্যায়ক্রমে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি।
কেন এ ক্বওমী মাদ্রাসা
ইসলাম এক মুকাম্মাল দ্বীন ও পূর্ণাঙ্গ নিযামে হায়াত। বস্তুতঃ ঈমান, আমল ও ইহ্সানের সমষ্টির নাম দ্বীন। আর অব্যাহত জিহাদ হল এর সর্বোচ্চ চুড়া। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবন ব্যাপী ত্যাগ, সাধনা, কুরবানী ও শ্রমের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার সরাসরি পথ নির্দেশনার আলোকে এরই সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন সাহাবায়ে কিরামের সুমহান জামাআত। তাঁরা হলেন হক ও হক্কানিয়্যাতের মাপকাঠি। তাঁরা ছিলেন হিদায়াতের এমন উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা, যে কেউ তাঁদের অনুসরণ করবে তারা সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যাবে। রিযায়ে ইলাহীর সুউচ্চ শিখরে তাঁদের অধিষ্ঠান। তাঁদের পথ ধরেই গড়ে উঠেছেন তাবিঈন, তাবে তাবিঈন, মুজাদ্দিদীন, মুহাদ্দিসীন, ফুক্বাহা ও সালিহীনের প্রজন্ম পরম্পরায় আকাবিরে উম্মতের এক সুমহান কাফেলা। আকাবিরে উম্মতের সুযোগ্য উত্তরসূরী ঈমানী আলোয় উজ্জীবিত এক মহান ব্যক্তিত্ব হলেন ইমামুল হিন্দ হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ্.)।
শিল্পবিপ্লবের কালে যখন তাগুতীশক্তি বস্তুবাদী দর্শনের উপর ভর করে উন্নয়ন, প্রগতি ও প্রযুক্তির মোহময়তার আবরণে সাম্রাজ্যবাদী দুরাকাঙ্খা পুরণে মত্ত হয়ে উঠে এবং যখন নাস্তিক্যবাদী মানবতা বিরোধী তথাকথিত সমাজকান্ডারী ব্যক্তিরা কমিউনিজমের জয়গান গাইতে আরম্ভ করে, তখন তাদের মুকাবিলায় এগিয়ে এলেন হযরত শাহ্ সাহেব (রাহ্.)। তিনি নববী সুন্নাহ্ ও শিক্ষার আলোকে ইসলামের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সকল বিধিবিধানের বিশ্লেষণ করে পেশ করলেন ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সার্বিক রূপরেখা এবং তাগুতী শক্তিকে রুখবার এক কার্যকর ব্যবস্থা। গড়ে উঠল হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয, হযরত শাহ্ ইসমাঈল শহীদ, হযরত সায়্যিদ আহ্মদ শহীদ ও হযরত মাওলানা আব্দুল হাই (রাহ্.) প্রমুখের নেতৃত্বে এক বিপ্লবী জামাআত। বালাকোটের প্রান্তরে রক্ত আখরে লেখা হল তাঁদের নাম। পরবর্তীতে এ ধারারই এক মহাপুরুষ হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কী (রাহ্.) নেতৃত্ব দেন সিপাহী বিদ্রোহ নামে প্রসিদ্ধ এই আযাদী আন্দোলনের।
১৮৫৭ সালের সিপাহী জনতার স্বাধীনতা আন্দোলন আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়ার পর উপমাহাদেশের উপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের দখলকে আরো সুসংহত করে নেয়। নেমে আসে নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম নেতা এবং উলামায়ে কিরামের উপর অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন। এতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। হাজারো মানুষ হয় কালাপানির নিঃসহ অত্যাচারের শিকার। চট্টগ্রাম থেকে খায়বার পর্যন্ত গ্রান্ড ট্রাংক রোডের দু’পাশের একটি বৃক্ষশাখাও এমন ছিলনা, যার মাঝে ঝুলছিলনা কোন শহীদের লাশ। ইংরেজ বেনিয়ার গোষ্ঠী মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনাকে খতম করে দেওয়ার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়। এহেন অবস্থায় চরম হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে ইসলাম প্রিয় জনতা।
চারিদিকে তখন ভীষণ দুর্দিন। স্যার সৈয়দ আহ্মদের নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলন নামে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের তোষন ও আপোষকামিতার সবক পড়ানো হচ্ছিল তখন। সে এক দুর্যোগময় মুহুর্তে এগিয়ে এলেন ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত, ওয়ালীউল্লাহী ফিক্রের আলম বরদার, উম্মতের কল্যাণ চিন্তায় দগ্ধ হৃদয়ের অধিকারী, কাসিমুল উলূম ওয়াল খাইরাত, হুজ্জাতুল ইসলাম, হযরত কাসিম নানুতুবী (রাহ্.) ও ফক্বীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
পৃথিবীর সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র ও আক্রমণসমূহের পূর্বাপর পর্যালোচনা করে নববী তা’লীম ও শিক্ষার আলোকে ইসলামী পুনঃজাগরণ এবং সংস্কারের এক সার্বিক ও কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণ করলেন তাঁরা। এরই প্রেক্ষিতে ১৮৬৭ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ইসলহামী প্রতিষ্ঠান। যার নাম দারুল উলূম দেওবন্দ।
দারুল উলূম দেওবন্দ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়। বরং কুরআন-হাদীসের নিরিখে নববী আলোয় গড়া ইসলামী মত ও পথের একটি মানবতাবাদী বিপ্লবী বিশ্বকেন্দ্র। মুক্তিকামী মানুষের প্রয়োজনে এমন কোন ডাক নেই এবং এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে নেতৃত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখেনি এই দারুল উলূম দেওবন্দ। এ প্রতিষ্ঠানটি বিনির্মাণে যে সমস্ত আকাবির হযরত নানুতুবী (রাহ্.)কে সাহায্য করেছেন তাঁরা হলেন, হাজী আবিদ হুসাইন, মাওলানা যুলফিকার আলী, মাওলানা ফযলুর রহ্মান, মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবী ও মাওলানা রফীউদ্দীন (রাহ্.)। প্রতিষ্ঠাতা হযরত নানুতুবী (রাহ্.)সহ তাঁদের সকলকে এক কথায় আকাবিরে সিত্তাহ্ বা ছয় মুরুব্বী বলা হয়।
দারুল উলূম দেওবন্দ এক ইলহামী বিদ্যাপীঠ
দারুল উলূম দেওবন্দ ঘটা করে প্রতিষ্ঠিত কোন প্রতিষ্ঠান নয়। বরং এ হচ্ছে এক ইলহামী বিদ্যাপীঠ। এর ভিত্তি ইলহামী, মূলনীতি ইলহামী, স্থান নির্বাচন ইলহামী, ইমারত নির্মাণ ইলহামী, এমনকি ছাত্রের ভর্তি এবং দাখেলাও ইলহামী।
“তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দ” গ্রন্থের ভূমিকায় একথা উল্লেখ আছে যে, আকাবিরে সিত্তাহ্ পরস্পর পরামর্শ করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর একে অপরকে বলতে লাগলেন, এরূপ প্রতিষ্ঠান বানানোর প্রয়োজনীয়তা আমি দীর্ঘ দিন যাবত অনুভব করে আসছিলাম, কেউ বল্লেন, স্বপ্নে আমাকে এরূপ দেখানো হয়েছিল।
আবার কেউ বল্লেন, কাশফের মাধ্যমে আমিও এমনটি অনুভব করেছিলাম। এতে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, এ ক্বওমী মাদ্রাসা হচ্ছে খালিস ইলহামী মাদ্রাসা। শুধু তাই নয়, পূর্বেকার বুযুর্গানে দ্বীন থেকেও অনুরূপ ইশারা বিদ্যমান রয়েছে। একদা হযরত সায়্যিদ আহ্মদ শহীদ (রাহ্.) দেওবন্দ এলাকা হয়ে সীমান্ত প্রদেশের দিকে যাচ্ছিলেন। মাদ্রাসার এ স্থানটিতে পৌঁছার পর তিনি বলছিলেন, “এ স্থান থেকে আমি ইল্মের সুঘ্রাণ পাচ্ছি”।
এমনিভাবে এর ইমারতও ইলহামী। মাদ্রাসার প্রথম ইমারত তথা নওদারার ভিত্তি স্থাপনের সময় মাটি কেটে নির্ধারিত স্থানে ভিত্তি রাখা হয়। ঐদিন রাত্রেই মুহ্তামিম হযরত মাওলানা শাহ্ রফী উদ্দীন (রাহ্.) স্বপ্নে দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশ্রীফ এনেছেন এবং তিনি তাঁকে বলেন, পূর্বের জায়গা যথেষ্ট নয়, এ স্থানে ভিত্তিস্থাপন কর। ভোরে তিনি ঐ স্থানে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লাঠি মুবারকের স্পষ্ট দাগ দেখতে পান।
অনুরূপ এর ছাত্র ভর্তিও ইলহামী। বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত মাওলানা শাহ্ রফীউদ্দীন (রাহ্.) মৌলসরী এলাকায় দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে কয়েকজন ছাত্র। এমতাবস্থায় দাওরা হাদীসের একজন ছাত্র বোর্ডিং ঘর থেকে খানা এনে হযরত মুহ্তামিম সাহেব (রাহ্.)-এর সামনে তরকারীর পেয়ালাটি নিক্ষেপ করতঃ বল্ল, “এই নিন আপনার ইহ্তিমাম। ডালে শুধু পানি আর পানি। এতে না আছে ঘি, আর না আছে মসলা।” সাথে আরো দু’চারটি কটুবাক্য। হযরত তাকে কিছু না বলে তার মাথা হতে পা পর্যন্ত তিনবার নজর করে বললেন, এ দারুল উলূমের ছাত্র নয়। এতে উপস্থিত ছাত্রদের মনে কৌতুহল জাগল।
তারা নাছোড় বান্দা হয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বল্লেন, একদা আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, মৌলসরী এলাকার কূপটি দুধে ভরপুর। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কূপটির পাড়ে দাঁড়িয়ে দুধ বন্টন করছেন। অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন পাত্রে করে দুধ নিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন দুধ গ্রহণকারীদের মধ্যে এই ছাত্রটিকে আমি দেখতে পাইনি। অতঃপর মুরাকাবার অবস্থায় আমার এ মর্মে কাশ্ফ হল যে, কুয়া দ্বারা দেওবন্দ মাদ্রাসা, দুধ দ্বারা ইল্ম এবং দুধ গ্রহণকারীদের দ্বারা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে বুঝানো হয়েছ। সুতরাং সে এই মাদ্রাসার ছাত্র হতে পারে না।
মা-আনা আলাইহি ওয়া আসহাবীর অনুসারী এ কাফেলা
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে তিয়াত্তরটি দল হবে। একটি দল ব্যতীত সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তারা কারা? উত্তরে তিনি বল্লেন, “মা-আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী- যে পথে আছি আমি ও আমার সাহাবীগণ”। এরই বাস্তব নমুনা হল এই ক্বওমী মাদ্রাসা। কেননা মা-আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী মানে সুন্নাত ও জামাআত। যাকে আমরা “আহ্লুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআত” বলে জানি।
আকাবিরে ক্বওমী মাদ্রাসা এ জামাআতের পথ ও মত থেকে এক চুল পরিমাণও বিচ্যুত হননি জীবনের কোন অধ্যায়ে। তাঁরা কুরআন-সুন্নাহকে গ্রহণ করেছেন রিজাল এর ব্যাখ্যার আলোকে। আর রিজালকে গ্রহণ করেছেন কুরআন-সুন্নাহর মাপকাঠিতে। কুরআন-সুন্নাহ্কে বাদ দিয়ে তাঁরা যেমনিভাবে রিজাল পুরুস্তীতে ডুবে যাননি এমনিভাবে তাঁরা রিজালকে বাদ দিয়ে কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কোনরূপ তাহ্রীফ, তা’বীল এবং ইন্তিহালের চোরাপথও উন্মোচন করেননি।
তারা জানেন, আকাবির তথা রিজালের ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান ও সবক হাসিল করাকেই হক বলা হয়। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ্ পরিপন্থী জ্ঞান এবং নিজের মনগড়া ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন ও সুন্নাহর সমঝকেই বাতিল বলা হয়। তাই তাঁরা কোন অবস্থাতেই ইফ্রাত-তাফ্রীত তথা প্রান্তিকতার শিকার হননি। বরং তারা সর্বদাই এতদুভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছেন। কাজেই আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে একথা বলতে পারি যে, ক্বওমী মাদ্রাসা হচ্ছে “উম্মাতাও ওয়াসাতান” মধ্যপন্থী- প্রান্তিকতাহীন উম্মত গড়বার এক ইলাহী কেন্দ্রভূমি।
এ নীতির সফল বাস্তবায়ন ঘটেছে এখানকার ছাত্র শিক্ষক সকলের মাঝে সর্বোতভাবে। তাই তাঁরা যেমনিভাবে আবেগ ও ইশ্ক বিবর্জিত নজদী নয়, অনুরূপভাবে আক্ল ও যুক্তি বিবর্জিত আবেগপ্রবণ ইশ্ক পূজারী ওয়াজদীও নয়। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা খলীল আহ্মদ সাহারানপুরী (রাহ্.)কে নজদীদের সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আকলের সাথে ইশ্ক আর ইশ্কের সাথে আকল এতদুভয়ের সমন্বয়ের মাঝেই রয়েছে হক তথা মহাসত্য। এরই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্বওমী মাদ্রাসার ভিত্তিভূমি দারুল উলূম দেওবন্দ।
উলূম ও ফুনূনের এক সমন্বিত শিক্ষাকেন্দ্র এ ক্বওমী মাদ্রাসা
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বর্ণযুগে সাহাবাগণ তাঁর সুহ্বতে এসে ইল্ম হাসিল করতেন। তাঁরা যা শিখতেন সে মুতাবেক আমল করতেন এবং নববী আখলাকের আলোকে নিজেদেরকে করে তুলতেন পরিশোধিত ও সুশোভিত। প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবার ছিল ঈমান, আমল ও ইহ্সানের সমন্বিত এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রিবাত ও খানকাভূমি। তাই দরবারে নবুওয়াতের ছাত্র সাহাবায়ে কিরাম এ দিকে যেমন কুরআনের ক্বারী ছিলেন। তেমনিভাবে তাঁরা কুরআনের হাফেজ, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, মুজাহিদ এবং শাইখে তরীকতও ছিলেন।
পরবর্তীকালে সমাজ বিবর্তনের পাশাপাশি উলূমে ইসলামিয়ার সাথে বিভিন্ন উলূম ও ফুনূনের সংযোজন হতে থাকে। উলূমে শরঈয়্যার সাথে উলূমে আক্বলিয়্যা এবং উলূমে আলিয়া তথা বহু সহায়ক উলূম এর সাথে সংযোজন করা হয়। কালক্রমে উলূমে নক্বলিয়্যার উপর উলূমে আক্বলিয়্যা দারুণভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে নেয়। এতে উলূমে নক্বলিয়্যার শিক্ষাক্ষেত্রে এক মন্দাভাব পরিলক্ষিত হয়। ঈমানী নূরে উদ্ভাসিত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (রাহ্.)এর হৃদয়ে তা দারুণভাবে রেখাপাত করে। তাই তিনি হাদীস ও তাফ্সীরের শিক্ষাকে অন্যান্য শিক্ষার উপর প্রাধান্য দেওয়া এবং বস্তুবাদের ব্যাপক হামলা থেকে দ্বীন ও ঈমানকে রক্ষা করার লক্ষ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন কারিকুলাম আবিষ্কার করেন এবং আক্বল ও যুক্তির আলোকে কুরআন ও সুন্নাহ্কে জনসমক্ষে তুলে ধরতে উদ্যোগী হন।
এতদুপলক্ষ্যে যুক্তিপূর্ণ তা’লীমের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন গ্রন্থও রচনা করেন। যুগের পরিবর্তনের সাথে নতুন নতুন দাবীও সংযোজিত হতে থাকে। তাই ওয়ালীউল্লাহী চিন্তাধারার যোগ্য উত্তরসূরী হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল গনী মুজাদ্দিদী (রাহ্.) ভাবলেন যে, শুধু যৌক্তিকভাবেই নয় বরং মাহ্সূসাতের মাধ্যমে দ্বীনের ব্যাখ্যা পেশ করা না গেলে দ্বীন ও ঈমানের এ সৌধটি মারাÍক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। তাই তিনি এর সাথে আরেকটি নতুন ধারার সংযোজন করেন।
পরবর্তীকালে বস্তুবাদের ফিত্না আরো মারাÍক আকার ধারণ করলে আকাবিরের যোগ্য উত্তরসূরী কাসিমুল উলূমি ওয়াল আইরাত হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ্.) এ কথা উপলব্ধি করলেন যে, এখন দ্বীনকে হিস্সিয়্যাত ও বদ্হিয়্যাত এর মাধ্যমে পেশ করতে হবে।
এ পর্যায়ে এসে দ্বীনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন ধারা সংযোজিত হয়। উসূল ঠিক রেখে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নতুন ধারা সংযোজনের এ সিলসিলায় পক্ষপাতমূলক চিন্তাধারা সর্বদাই পরিহার করা হয়েছে অত্যন্ত সচেতনতা ও বিচক্ষণতার সাথে। এখানে ইল্ম থেকে আমলকে পৃথক করে দেখা হয়নি কখনো। বরং ইল্মের সাথে আমল এবং আখলাকের সাথে রূহানিয়্যাতের প্রশিক্ষণ এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে নিয়মিতভাবে।
এ শিক্ষা ধারার বৈশিষ্ট হল, নকলের সাথে আক্বল, আক্বলের সাথে অনুভূতি এবং অনুভূতির সাথে দলীলে বদহীর সমন্বয় সাধন। এমনিভাবে ইল্মের সাথে মা’রিফাত, হুকুমের সাথে হিকমত, মা’ক্বুলের সাথে মাহ্সূস, ক্বানূনের সাথে মুসলিহাত, শরীয়তের সাথে তরীক্বত, ঈমানের সাথে ইহ্সান এবং আত্মরক্ষার সাথে আক্রমণ তথা সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থাই এ ক্বওমী মাদ্রাসার অন্যতম বৈশিষ্ট। এরই ফলশ্রুতিতে আক্বাঈদ ও বিশ্বাস, আখলাক ও নৈতিকতা, তা’লীম ও তাদ্রীস, তরবিয়্যাত ও প্রশিক্ষণ, তাস্নীফ ও তালীফ, দাওয়াত ও তাবলীগ, ইহ্সান ও তাযকিয়া, দাওয়াত ও জিহাদ, রাজনীতি ও অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, এক কথায় মানব কল্যাণকামিতা ও উসওয়ায়ে নবুওয়াতের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে এই ক্বওমী মাদ্রাসার সূর্য সন্তানদের নেতৃস্থানীয় সরব উপস্থিতি ও অবদান নেই।
আধ্যাত্মিক রাহ্নুমায়ীর প্রাণকেন্দ্র এ ক্বওমী মাদ্রাসা
তাহ্যীবুল আখলাক, তাযকিয়ায়ে বাতিন তথা আত্মশুদ্ধিই হল দ্বীনি কাজের মূল নিয়ামক বা চালিকাশক্তি। কেননা, তাহ্যীবুল আখলাক মানে নিজেকে আখলাকে রযীলা তথা কিনা, রিয়া, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা, পরশ্রিকাতরতা, গীবত, চোগলখোরী, ধোঁকা-প্রতারণা, মিথ্যা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ইত্যাদি হতে পাক সাফ করে আখলাকে হামীদা তথা সততা, আমানতদারী, অঙ্গীকার রক্ষা করণ, অন্যের প্রতি ভাল ধারণা পোষণ, অন্যের কল্যাণকামনা, ইখলাস, লিল্লাহিয়্যাত, নামাযে খুশুখুযু হাসিল করণ, সেহেরগাহী আদায় করে রোনাযারী করণ, নফ্সের মুহাসাবা ও জায়েযা গ্রহণ ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত করা।
এটা আখলাক বা আত্মশুদ্ধির মূল কথা। হাদীসে জিব্রাঈলে একেই ইহ্সান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একথা অস্বীকার করার জো নেই। এ সূত্র ধরেই ইমামুত্ তরীক্বত শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী, শাইখ শিহাব উদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী, হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী, শাইখ মুঈনুদ্দীন চিশ্তী, হযরত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহ্লভী এবং হযরত সায়্যিদ আহ্মদ শহীদ (রাহ্.) প্রমুখ বুযুর্গানে দ্বীন নিজ নিজ যুগে মুসলিম উম্মাহ্কে আধ্যাত্মিক রাহ্নুমায়ী করেছেন।
পরবর্তীকালে আকাবিরে ক্বওমী মাদ্রাসার হযরত কাসেম নানুতুবী, ফক্বীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহ্মদ গাঙ্গুহী, হাকীমুল ইম্মত হযরত মাওলানা আশ্রাফ আলী থানভী, শাইখুল আরব ওয়াল আযম শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহ্মদ মাদানী, মাওলানা সাঈদ আহ্মদ সন্দ্বীপী, মুফ্তিয়ে আযম হযরত মাওলান ফয়যুল্লাহ্, মাওলানা শামছুল হক্ ফরিদপুরী, মাওলানা আত্হার আলী, শাইখে বাঘা (রাহ.) প্রমুখ মাশাইখে কিরাম এ ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন। তাঁদের এ মেহনতের বদৌলতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, আফ্রিকা, আমেরিকা, ইউরোপ প্রভৃতি দেশে লক্ষ লক্ষ আল্লাহ্ প্রেমিক ইলাহী প্রেমে মত্ত হয়ে আল্লাহু আল্লাহু শব্দের গুঞ্জরণে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছে। এ পর্যায়ে ক্বওমী মাদ্রাসার ভূমিকা স্মরণীয়।
হযরত থানভী (রাহ্.) বলেন, পূর্বে তাসাউফের ক্ষেত্রে পূর্ণতা অর্জন না করা ব্যতীত দাওরা ফারিগ কোন ছাত্রকে সনদ প্রদান করা হত না। এসব মাদ্রাসা সমূহে তাসাউফের বিষয়টি সর্বদাই সযতেœ লালিত হয়ে আসছে। ইল্মের সাথে আমল, আমলের সাথে রূহানিয়্যাতের অন্যতম লালনক্ষেত্র এ ক্বওমী মাদ্রাসা। হযরত শাইখুল হিন্দ (রাহ্.) মাদারে ইল্মী দারুল উলূম দেওবন্দ সম্বন্ধে বলেছেন, “দিনের বেলায় দারুল উলূমকে দেখা যেত যাহিরী ইল্ম চর্চার এক শিক্ষাকেন্দ্র রূপে। আর রাতের বেলা দেখা যেত একে খানকাভূমি হিসেবে”। বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়ের যে ধ্বস নেমেছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য এ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই।
দ্বীনের বলিষ্ঠ দূর্গ এ ক্বওমী মাদ্রাসা
ইসলাম ক্বিয়ামত পর্যন্তের জন্য আল্লাহর মনোনীত দ্বীন। তিনি নিজেই এর হিফাযতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- “আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক”। এ অঙ্গীকারের ফলশ্রুতিতে যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে যুগে যুগে আল্লাহ্ তায়ালা এমন এমন রিজাল এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যারা দ্বীনের ইশাআত ও প্রচারের পাশাপাশি এ দ্বীনকে সর্বপ্রকার ভ্রান্তি, বাড়াবাড়ি ও হামলা থেকে হিফাযত করেছেন।
এ ধারারই উত্তরসূরী হলেন, আকাবিরে ক্বওমী মাদ্রাসা। হিফাযতে দ্বীনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, এমন কোন শাখা নেই যেখানে আমাদের আসলাফ ও আকাবিরের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল না। ইসলাম ও মুসলমানদের উপর যেখানেই আক্রমণ হয়েছে সেখানেই তারা ব্যাঘ্রের ন্যায় বজ্র কঠিন হুংকার দিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং ইসলামের দুশমনদের সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছেন। শিখদের চক্রান্ত, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ছলচাতুরী, আরিয়া সমাজ ও আর্যদের ফিত্নাসহ শিয়া, কাদিয়ানী, বিদ্আতী, মওদুদী, আলীগড়ী, নায়চারী, মাহ্দূবী, বাহাঈ তথা সর্বপ্রকারের ফিত্নার মুকাবেলায় আমাদের আকাবির ও বুযূর্গানে দ্বীন মুনাজারা ও কলমী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং হক্কে হক্ আর বাতিলকে বাতিল হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন পরিস্কারভাবে। রাজ্যহারা মুসলমানদেরকে খ্রীস্টান বানানোর লক্ষ্যে ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্যত হলে এগিয়ে আসেন মাওলানা রহ্মাতুল্লাহ্ কিরানভী (রাহ্.)সহ তাঁর আরো কতিপয় সহযোদ্ধা। মুকাবেলা হয় পাদ্রী ফান্ডারের সাথে। পরাজিত হয়ে পাদ্রী ফান্ডার রাতের অন্ধকারে হিন্দুস্তান ছেড়ে পলায়ন করে। এমনি আরো বহু ঘটনা।
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতীয় এ উপমহাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যে আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে, তাতেও ওয়ালীউল্লাহী চিন্তাধারার মানষপুত্র ক্বওমী মাদ্রাসার উলামাদের ভূমিকা অসামান্য। বরং এ ক্ষেত্রেও তারা অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। জান দিয়েছেন, মাল দিয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন, বাড়ি-ঘর লুট হয়েছে তথাপিও দেশকে তারা আযাদ করেছেন। ঐতিহাসিক মাল্টা, করাচী ও নৈতিতাল কারাগার আজও তাদের সেই রক্তাক্ত ইতিহাসকে বক্ষে ধারণ করে আছে। ঐতিহাসিক রেশ্মী রুমাল আন্দোলনের কথা দেশবাসী কখনো ভুলতে পারবে না।
বস্তুতঃ এক চুড়ান্ত জিহাদের লক্ষ্যেই এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আযাদী আন্দোলনের সূর্য সন্তান মাদারে ইল্মী দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র হযরত শাইখুলহিন্দ (রাহ্.) বলেন, “হযরত নানুতুবী (রাহ্.) কি এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু দরস-তাদরীস, তা’লীম-তাআল্লুম তথা শুধু পাঠ দেওয়া এবং পাঠগ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন? মাদ্রাসা তো আমার সামনে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমার জানা মতে এ প্রতিষ্ঠানটি ১৮৫৭ সালের আপাতঃ ব্যর্থতার পর কায়েম করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল, এমন কোন কেন্দ্র কায়েম করা; যার তত্ত্বাবধানে ১৮৫৭ সালের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ফেলে কাঙ্খিত বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য লোকদেরকে তৈরী করা হবে। তিনি আরো বলেন, শুধু দরস্-তদ্রীস এবং তা’লীম-তাআল্লুম যাদের উদ্দেশ্য আমি তাদের পথে বাধা হবো না। কিন্তু আমি তো আমার জন্য ঐ পথই বেছে নিয়েছি যার জন্য শ্রদ্ধেয় উস্তাদ দারুল উলূমের এ ব্যবস্থাপনার ইন্তিজাম করেছেন”।
প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই দারুল উলূম এ ব্যাপারে সচেতন ছিল এবং জিহাদী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এরই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার সূর্য তাঁরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন। তৎকালে আকাবিরের এ আন্দোলন না হলে ভারত স্বাধীন হত না, পাকিস্তান হত না এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশেরও অভ্যূদয় ঘটত না।
ক্বওমী মাদ্রাসার ক্রমবিকাশের ধারা
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুফ্ফায় তা’লীমী যে সিলসিলা জারী করেছিলেন, এর প্রচলিত রূপই এ ক্বওমী মাদ্রাসা। ১৮৬৭ সনে ঐতিহাসিক ডালিম বৃক্ষের নীচে প্রতিষ্ঠিত হয় এ মাদ্রাসা। আমি পূর্বে এ কথা উল্লেখ করেছি যে, এটা ঘটা করে স্থাপিত কোন প্রতিষ্ঠান নয়। বরং এ জাতীয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা তৎকালীন বুযুর্গানে দ্বীনের অনেকেরই কাশ্ফ ছিল। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বর্তমানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া দ্বীনের হিফাযত সম্ভব নয়। তাই তারা বিপুল পরিমাণে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিন্তা ভাবনা অব্যাহত রাখেন।
এরই ফলশ্রুতিতে ছয় মাস পর দারুল উলূমের নিসাব, আদর্শ, কর্মনীতি ও এর পৃষ্ঠপোষকতায় সাহারানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় “মুজাহিরুল উলূম মাদ্রাসা”। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্থানে তথা মীরাঠ, কানপুর, থানাভবন, মুরাদাবাদ প্রভৃতি স্থানে আরো মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে দারুল উলূম থেকে উত্তীর্ণ আলিমগণ শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে-বিদেশে এই কারিকুলামের অনুসরণে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার তৎপরতা শুরু করেন। ফলে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে অসংখ্য ক্বওমী মাদ্রাসা গড়ে উঠে। ১৯৩৭ সনের পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায় যে, তখন কেবল ভারতেই এ পদ্ধতির অন্ততঃ এক সহ¯্র দ্বীনি মাদ্রাসা ছিল।
১৯৭১ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশেও এ জাতীয় বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ক্বওমী মাদ্রাসা হল, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ দেশে প্রায় ৪৪৩টি ক্বওমী মাদ্রাসা ছিল। তন্মধ্যে প্রায় ৫১টি ছিল দাওরায়ে হাদীস মাদ্রাসা। বর্তমানে ছোট বড় ক্বওমী মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় চার হাজারেরও অধিক। উপমহাদেশের বাইরেও এ তৎপরতা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি মক্কা-মদীনায় পর্যন্ত এ তৎপরতা বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছে। এসব কিছুই আমাদের আকাবির ও আসলাফের অবদান।
আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সকলকে ক্বওমী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা ও এ ধারাবাহিকতার প্রসারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে দ্বীনের হিফাযতে আত্মনিয়োগ করার তাওফীক দান করেন এবং সর্বপ্রকার গুমরাহী থেকে হিফাযত করেন। পরিশেষে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
“তাঁরাই মোদের পূর্বসূরী
যাঁদের নিয়ে গর্ব করি
কোন্ মুখেতে বড়াই কর
নাও তো দেখি তাঁদের জুড়ি?”
No comments:
Post a Comment