মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবীবি
মুসলিম সম্প্রদায়ে চারটি মাজহাব স্বীকৃত। এই চার মাজহাবের চার ইমাম রয়েছেন,
যাঁরা পুরো মুসলিম সমাজেই বরেণ্য ও সম্মানিত। হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও
হাম্বলি_ এই চার মাজহাবের চার ইমাম প্রায় সমসাময়িক কালের ইসলামী চিন্তাবিদ ও
শরিয়তের ব্যাখ্যাকার। লক্ষ করার বিষয় হলো, এ চার ইমাম ইসলামের শরিয়ত নিয়ে
নিজেদের চিন্তাধারাপ্রসূত দল বা উপদল তৈরি করেননি। তাঁরা প্রত্যেকেই গোটা
মুসলিম সমাজের কাছে সমানভাবে গ্রহণীয় ও বরণীয়। শরিয়ত ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে
তাঁরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছেন। এর ফলে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এসেছে
বৈচিত্র্য এবং পরে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চার মাজহাব। আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো,
এই মুজতাহিদ ইমামরা শরিয়ত বিধিবদ্ধ করার কাজ করেছেন মহানবী (সা.)-এর ওফাতের
প্রায় ২০০ বছর পর। সুতরাং সহজেই বোঝা যায় শরিয়তের ব্যাখ্যা প্রদান,
বিধিবদ্ধকরণ ও মাজহাবের অভ্যুদয়_এগুলো কোনো বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর বিষয় নয়,
বরং জ্ঞান চর্চার ফসল। আমরা এ পাতায় ধারাবাহিকভাবে চার ইমামের কর্মময় জীবন ও
তাঁদের মাজহাবের সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করব। হানাফি মাজহাবের
প্রতিষ্ঠাতা ইমামে আজম আবু হানিফা। তাঁর প্রকৃত নাম আল নোমান ইবনে সাবিত
(রহ.)। ৮০ হিজরিতে (৬৯৯ খ্রি.) ইরাকের কুফা নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর
জন্ম সাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশের
মতে, তিনি ৮০ হিজরিতেই জন্মগ্রহণ করেন। আবু হানিফা (রহ.)-এর শেষ বয়সে খলিফা আল
মানসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) মুসলিম সাম্রাজ্যের ভাগ্যনিয়ন্তা ছিলেন। তাঁর কোপানলে
পরেই ইসলামের এই মহামনীষী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
আবু হানিফা (রহ.)-এর বাবা সাবিত ইবন যুতী (রহ.) ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভূত অভিজাত
ব্যক্তিদের একজন। তাঁর দাদা যুতী (রা.) ছিলেন কাবুলের অধিবাসী। আবু হানিফা
(রহ.) শৈশবকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী, প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এবং অসাধারণ
স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময়ই ইল্ম ও ইসলামী সংস্কৃতির
লালনভূমি কুফা নগরীতে বসবাস করেন এবং জ্ঞান আহরণ, বিতরণ এবং ইল্মী গবেষণায়
জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁর বাবা একজন ধর্মভীরু সওদাগর ছিলেন। ছেলের অসামান্য মেধা
দেখে মুগ্ধ ও আনন্দিত হয়ে বাবা তাঁকে নিজের ব্যবসায় জড়িত না করে উচ্চশিক্ষা
দেওয়ার জন্য মনোযোগী হন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই সমগ্র কোরআন হেফজ করে হাফেজে
কোরআনের মর্যাদা লাভ করেন। সেই সঙ্গে তিনিহাদিসশাস্ত্র, ভাষা ও ইসলামের নানা
বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ধর্মানুরাগী।
দুনিয়াবি খ্যাতি-সম্মান বা অর্থ-সম্পদ কিছুতেই তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তিনি
খলিফা বা স্থানীয় শাসকদের অনুগ্রহ ভিখারি ছিলেন না। তিনি অফুরন্ত পাণ্ডিত্য ও
ইসলামী ব্যবহারতত্ত্বে অনন্য সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করে মুসলিম উম্মাহ্র জন্য
শরিয়তের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে গেছেন। তিনি কুফা নগরীতেই স্বীয় কর্মস্থল
নির্ধারণ করে সেখানেই বসবাস করতেন। সে সময় কুফার শাসনকর্তা ছিলেন ইবনে হুবায়রা
নামক এক স্বেচ্ছাচারী লোক। তিনি আবু হানিফা (রহ.)-এর পাণ্ডিত্যের কথা ও তাঁর
অসামান্য ব্যুৎপত্তির কথা শ্রবণ করে তাঁকে কুফা নগরীর কাজির পদ গ্রহণ করতে
আহ্বান করেন। কিন্তু জ্ঞান সাধক আবু হানিফা (রহ.) এ লোভনীয় পদ গ্রহণ করতে
অস্বীকার করলেন। পরে বাগদাদের খলিফা তাঁকে সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি বা
কাজি নিয়োগ করার প্রস্তাব দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বাদশাহ ইমাম
সাহেবকে গ্রেপ্তার করে বেত্রাঘাত করার আদেশ দিলেন। কথিত আছে যে ইমাম সাহেবকে
বন্দি করে এনে প্রকাশ্য স্থানে ১১ দিন পর্যন্ত প্রত্যহ ১০ ঘা করে বেত্রাঘাত
করা হতো। এর পরেও দাম্ভিক শাসক আল মানসুর তাঁকে অব্যহতি দেননি। আবু হানিফা
(রহ.)-এর অপরাধ ছিল তাঁর নির্ভীক স্পষ্টবাদিতা। তিনি আস্সাফ্ফাহ বা
রক্তপাতকারী বলে আখ্যায়িত আল্ মানসুরের অমানুষিক হত্যাকাণ্ড ও ইসলাম বিরুদ্ধ
জোরপূর্বক শাসনের প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেন। মূলত এ অপরাধে বাদশাহ আল মানসুর
আবু হানিফাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং অনেকের মতে, তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে
হত্যা করতে গোপনে আদেশ প্রদান করেন। কারাকক্ষের অন্তরালেই ইসলামের এ জ্ঞানসাধক
(১৫০ হিজরি ৭৬৭ খ্রি.) এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। আবু হানিফা
(রহ.)-এর হাতেই 'কি্বয়াস' মুসলিম আইনশাস্ত্রের একটি বিশিষ্ট শাখায় রূপায়িত হয়।
এ 'কি্বয়াসে'র পূর্ণাঙ্গ প্রকাশেই তাঁর হাতে 'ইসতিহসান' বা ইকুইটির উদ্ভব হয়।
এটি দৃষ্টান্ত দিয়ে 'কি্বয়াস' ও 'ইসতিহসান'-এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি_ শরিয়ত
অনুযায়ী বিক্রয় সম্বন্ধে কোনো চুক্তি করতে হলে বিক্রয়ের বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব
চুক্তির সময় থাকা দরকার। এ নিয়মানুসারে কোনো শিল্পী বা কারিগরের সঙ্গে তাঁর
উৎপাদিত বস্তুর ক্রয়ের আগাম চুক্তি প্রথানুযায়ী 'ইসতিহসান'। এ ধরনের চুক্তিকে
ন্যায়সংগত হিসেবে আইনে স্বীকৃতি দেয়। আবু হানিফা (রহ.)-এর আরো অভিমত ছিল যে
'ইজমায়' মুসলমানদের অধিকার সর্বকালেই আছে।
গোঁড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মতে
'ইজমা'র অধিকার কেবলমাত্র আসহাবে রাসুল বা রাসুলের সাক্ষাৎ সহচরদের এবং বড়জোর
তাঁদের সহচরদের অর্থাৎ তাবেয়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আবু হানিফা (রহ.)
উদাত্তস্বরে ঘোষণা করেন যে, সর্ব যুগের সব মুসলমানের ইজমায় নিরঙ্কুশ অধিকার
রয়েছে। তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন, প্রচলিত দেশাচার ও লোকায়ত রীতিনীতি এবং কৃষ্টি
ও ঐতিহ্য আইন-সংকলনের কাজে বিশেষ সহায়ক। ইসলামে এ মতবাদ তিনিই প্রথমে স্বীকার
করেন। এর ফলে মুসলিম ব্যবহারশাস্ত্রে 'ফরফ্' বা দেশাচার ও প্রথার মর্যাদা
স্বীকৃত হয়েছে। তাঁর মতে কোরআন ও হাদিস মুসলিম আইনশাস্ত্রের মৌলিক ভিত্তি।
'ইজমা'র স্থান এর পরেই এবং 'কি্বয়াস', 'ইসতিহসান' ও 'উরফ্' দ্বিতীয় স্তরের
উপাদান। হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর শরিয়ত ব্যাখ্যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল
মর্মবস্তুনির্ভর। তিনি শাব্দিক অর্থের চেয়ে মর্মার্থের ওপর গুরুত্ব আরোপ
করেছেন বেশি। জুমার খোতবা নিজ মাতৃভাষায় দেওয়া যেতে পারে_এ ব্যাপারেও একমত
প্রকাশ করেছেন। যেমন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কথা উল্লেখ করে আল মুহিতুল
বুরহানি [(প্রণেতা ইমাম বুরহানুদ্দীন ইবনে মাজাহ) দ্বিতীয় খণ্ডের ১৬৭ পৃষ্ঠায়
কিতাবুস সালাত আল ফাসলুল খামেসওয়াল ইশরুন ফি সালাতিল জুমা] গ্রন্থে তিনি
উল্লেখ করেছেন, 'খতিব সাহেব অবস্থা বিবেচনায় যদি ফার্সিতে খোতবা দেন, হজরত
ইমাম আবু হানিফার দৃষ্টিতে তা বৈধ।' মুসলিম ধর্মতাত্তি্বকদের মধ্যে তিনি এমনই
উদারমনা ও প্রগতিপন্থী ছিলেন। হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁর জীবনের ৫২ বছর
উমাইয়া খিলাফতে এবং ১৮ বছর আব্বাসীয় খিলাফতে কাটান। মূলত তিনি মুসলিম
সামাজ্যের দুইটি বংশের তথাকথিত খেলাফত আমল স্বয়ং গভীরভাবে দেখার সুযোগ লাভ
করেন। উমাইয়া খেলাফতের জীবনকাল এবং তারপর সেই খিলাফতের পতন যুগও প্রত্যক্ষ
করেন। আব্বাসীয় খিলাফতের সেই যুগও তিনি দেখার সুযোগ পান, যখন পারস্য অঞ্চলে
অত্যন্ত সংগোপনে উমাইয়া শাসনের পতন ঘটানোর জন্য আন্দোলনের সূচনা লাভ করে। আর
সেই আন্দোলন উমাইয়া শাসকদের চোখের অন্তরালে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।
এভাবে আব্বাসীয়রা পরবর্তী সময়ে উমাইয়াদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিনিয়ে
নিতে সক্ষম হয়। আব্বাসীয়রা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটাত্দীয়ের কারণে সত্যিকার
অর্থে তাঁরাই খিলাফত তথা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী এই দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের
মধ্যে প্রচার করা হয়। কারবালা প্রান্তরে এজিদের হাতে রাসুল (সা.)-এর বংশধরদের
পরাজয়ের প্রতিশোধও এর প্রেরণা ছিল। হজরত ইমাম আবুহানিফা (রহ.) এসব রাজনৈতিক
অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হননি এবং তিনি এসব আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে
বিরত ছিলেন। উমাইয়া শাসকদের প্রতি তাঁর কোনো সমর্থন ছিল না এবং আন্দোলনকারী
নেতাদের সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
অত্যন্ত স্পর্শকাতর মনের মানুষ ছিলেন। কারো কোনো দুঃখ-কষ্ট দেখলে ভেতর থেকেই
তিনি উতলা হয়ে উঠতেন। একবার তিনি মসজিদে দরস দিচ্ছিলেন, কেউ একজন এসে বলল,
অমুকে দালানের ওপর থেকে পড়ে গেছে। এ কথা শুনে তিনি এত জোরে আর্তচিৎকার করলেন
যে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেল। তিনি হন্তদন্ত খালি পায়েই ছুটলেন সেই লোকের
বাড়ির দিকে। এমন উন্নততর হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তিনি। অথচ নিজের ওপর কোনো বিপদ
এলে তা নীরবে একা একাই সয়ে যেতেন। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী ও তার পাইক-পেয়াদা
কতভাবে কত রকম তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, যার হিসাব নেই। কিন্তু তারা কোনোভাবেই তাঁর
মাথা নত করতে পারেনি। উমাইয়া বা আব্বাসিয়া কোনো বংশের স্বৈরাচারী শাসকরাই
পারেননি তাঁকে তাঁদের দরবারি মোল্লা বানাতে। তিনি জগৎবাসীর জন্য ইসলাম ধর্মের
মহান শিক্ষার রূপরেখা উপহার দিয়ে গেছেন।।
রব্বে কারিম তাঁকে জান্নাতের উচ্চ আসনে সমাসীন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।।
.
.
মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবীবি
খতীবঃ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় কাশিপুর বড় মসজিদ, নারায়ণগঞ্জ।
szarif786@gmail.com
01914555679
মুসলিম সম্প্রদায়ে চারটি মাজহাব স্বীকৃত। এই চার মাজহাবের চার ইমাম রয়েছেন,
যাঁরা পুরো মুসলিম সমাজেই বরেণ্য ও সম্মানিত। হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও
হাম্বলি_ এই চার মাজহাবের চার ইমাম প্রায় সমসাময়িক কালের ইসলামী চিন্তাবিদ ও
শরিয়তের ব্যাখ্যাকার। লক্ষ করার বিষয় হলো, এ চার ইমাম ইসলামের শরিয়ত নিয়ে
নিজেদের চিন্তাধারাপ্রসূত দল বা উপদল তৈরি করেননি। তাঁরা প্রত্যেকেই গোটা
মুসলিম সমাজের কাছে সমানভাবে গ্রহণীয় ও বরণীয়। শরিয়ত ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে
তাঁরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছেন। এর ফলে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এসেছে
বৈচিত্র্য এবং পরে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চার মাজহাব। আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো,
এই মুজতাহিদ ইমামরা শরিয়ত বিধিবদ্ধ করার কাজ করেছেন মহানবী (সা.)-এর ওফাতের
প্রায় ২০০ বছর পর। সুতরাং সহজেই বোঝা যায় শরিয়তের ব্যাখ্যা প্রদান,
বিধিবদ্ধকরণ ও মাজহাবের অভ্যুদয়_এগুলো কোনো বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর বিষয় নয়,
বরং জ্ঞান চর্চার ফসল। আমরা এ পাতায় ধারাবাহিকভাবে চার ইমামের কর্মময় জীবন ও
তাঁদের মাজহাবের সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করব। হানাফি মাজহাবের
প্রতিষ্ঠাতা ইমামে আজম আবু হানিফা। তাঁর প্রকৃত নাম আল নোমান ইবনে সাবিত
(রহ.)। ৮০ হিজরিতে (৬৯৯ খ্রি.) ইরাকের কুফা নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর
জন্ম সাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশের
মতে, তিনি ৮০ হিজরিতেই জন্মগ্রহণ করেন। আবু হানিফা (রহ.)-এর শেষ বয়সে খলিফা আল
মানসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) মুসলিম সাম্রাজ্যের ভাগ্যনিয়ন্তা ছিলেন। তাঁর কোপানলে
পরেই ইসলামের এই মহামনীষী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
আবু হানিফা (রহ.)-এর বাবা সাবিত ইবন যুতী (রহ.) ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভূত অভিজাত
ব্যক্তিদের একজন। তাঁর দাদা যুতী (রা.) ছিলেন কাবুলের অধিবাসী। আবু হানিফা
(রহ.) শৈশবকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী, প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এবং অসাধারণ
স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময়ই ইল্ম ও ইসলামী সংস্কৃতির
লালনভূমি কুফা নগরীতে বসবাস করেন এবং জ্ঞান আহরণ, বিতরণ এবং ইল্মী গবেষণায়
জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁর বাবা একজন ধর্মভীরু সওদাগর ছিলেন। ছেলের অসামান্য মেধা
দেখে মুগ্ধ ও আনন্দিত হয়ে বাবা তাঁকে নিজের ব্যবসায় জড়িত না করে উচ্চশিক্ষা
দেওয়ার জন্য মনোযোগী হন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই সমগ্র কোরআন হেফজ করে হাফেজে
কোরআনের মর্যাদা লাভ করেন। সেই সঙ্গে তিনিহাদিসশাস্ত্র, ভাষা ও ইসলামের নানা
বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ধর্মানুরাগী।
দুনিয়াবি খ্যাতি-সম্মান বা অর্থ-সম্পদ কিছুতেই তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। তিনি
খলিফা বা স্থানীয় শাসকদের অনুগ্রহ ভিখারি ছিলেন না। তিনি অফুরন্ত পাণ্ডিত্য ও
ইসলামী ব্যবহারতত্ত্বে অনন্য সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করে মুসলিম উম্মাহ্র জন্য
শরিয়তের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে গেছেন। তিনি কুফা নগরীতেই স্বীয় কর্মস্থল
নির্ধারণ করে সেখানেই বসবাস করতেন। সে সময় কুফার শাসনকর্তা ছিলেন ইবনে হুবায়রা
নামক এক স্বেচ্ছাচারী লোক। তিনি আবু হানিফা (রহ.)-এর পাণ্ডিত্যের কথা ও তাঁর
অসামান্য ব্যুৎপত্তির কথা শ্রবণ করে তাঁকে কুফা নগরীর কাজির পদ গ্রহণ করতে
আহ্বান করেন। কিন্তু জ্ঞান সাধক আবু হানিফা (রহ.) এ লোভনীয় পদ গ্রহণ করতে
অস্বীকার করলেন। পরে বাগদাদের খলিফা তাঁকে সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি বা
কাজি নিয়োগ করার প্রস্তাব দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বাদশাহ ইমাম
সাহেবকে গ্রেপ্তার করে বেত্রাঘাত করার আদেশ দিলেন। কথিত আছে যে ইমাম সাহেবকে
বন্দি করে এনে প্রকাশ্য স্থানে ১১ দিন পর্যন্ত প্রত্যহ ১০ ঘা করে বেত্রাঘাত
করা হতো। এর পরেও দাম্ভিক শাসক আল মানসুর তাঁকে অব্যহতি দেননি। আবু হানিফা
(রহ.)-এর অপরাধ ছিল তাঁর নির্ভীক স্পষ্টবাদিতা। তিনি আস্সাফ্ফাহ বা
রক্তপাতকারী বলে আখ্যায়িত আল্ মানসুরের অমানুষিক হত্যাকাণ্ড ও ইসলাম বিরুদ্ধ
জোরপূর্বক শাসনের প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেন। মূলত এ অপরাধে বাদশাহ আল মানসুর
আবু হানিফাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং অনেকের মতে, তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে
হত্যা করতে গোপনে আদেশ প্রদান করেন। কারাকক্ষের অন্তরালেই ইসলামের এ জ্ঞানসাধক
(১৫০ হিজরি ৭৬৭ খ্রি.) এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। আবু হানিফা
(রহ.)-এর হাতেই 'কি্বয়াস' মুসলিম আইনশাস্ত্রের একটি বিশিষ্ট শাখায় রূপায়িত হয়।
এ 'কি্বয়াসে'র পূর্ণাঙ্গ প্রকাশেই তাঁর হাতে 'ইসতিহসান' বা ইকুইটির উদ্ভব হয়।
এটি দৃষ্টান্ত দিয়ে 'কি্বয়াস' ও 'ইসতিহসান'-এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি_ শরিয়ত
অনুযায়ী বিক্রয় সম্বন্ধে কোনো চুক্তি করতে হলে বিক্রয়ের বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব
চুক্তির সময় থাকা দরকার। এ নিয়মানুসারে কোনো শিল্পী বা কারিগরের সঙ্গে তাঁর
উৎপাদিত বস্তুর ক্রয়ের আগাম চুক্তি প্রথানুযায়ী 'ইসতিহসান'। এ ধরনের চুক্তিকে
ন্যায়সংগত হিসেবে আইনে স্বীকৃতি দেয়। আবু হানিফা (রহ.)-এর আরো অভিমত ছিল যে
'ইজমায়' মুসলমানদের অধিকার সর্বকালেই আছে।
গোঁড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মতে
'ইজমা'র অধিকার কেবলমাত্র আসহাবে রাসুল বা রাসুলের সাক্ষাৎ সহচরদের এবং বড়জোর
তাঁদের সহচরদের অর্থাৎ তাবেয়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আবু হানিফা (রহ.)
উদাত্তস্বরে ঘোষণা করেন যে, সর্ব যুগের সব মুসলমানের ইজমায় নিরঙ্কুশ অধিকার
রয়েছে। তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন, প্রচলিত দেশাচার ও লোকায়ত রীতিনীতি এবং কৃষ্টি
ও ঐতিহ্য আইন-সংকলনের কাজে বিশেষ সহায়ক। ইসলামে এ মতবাদ তিনিই প্রথমে স্বীকার
করেন। এর ফলে মুসলিম ব্যবহারশাস্ত্রে 'ফরফ্' বা দেশাচার ও প্রথার মর্যাদা
স্বীকৃত হয়েছে। তাঁর মতে কোরআন ও হাদিস মুসলিম আইনশাস্ত্রের মৌলিক ভিত্তি।
'ইজমা'র স্থান এর পরেই এবং 'কি্বয়াস', 'ইসতিহসান' ও 'উরফ্' দ্বিতীয় স্তরের
উপাদান। হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর শরিয়ত ব্যাখ্যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল
মর্মবস্তুনির্ভর। তিনি শাব্দিক অর্থের চেয়ে মর্মার্থের ওপর গুরুত্ব আরোপ
করেছেন বেশি। জুমার খোতবা নিজ মাতৃভাষায় দেওয়া যেতে পারে_এ ব্যাপারেও একমত
প্রকাশ করেছেন। যেমন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কথা উল্লেখ করে আল মুহিতুল
বুরহানি [(প্রণেতা ইমাম বুরহানুদ্দীন ইবনে মাজাহ) দ্বিতীয় খণ্ডের ১৬৭ পৃষ্ঠায়
কিতাবুস সালাত আল ফাসলুল খামেসওয়াল ইশরুন ফি সালাতিল জুমা] গ্রন্থে তিনি
উল্লেখ করেছেন, 'খতিব সাহেব অবস্থা বিবেচনায় যদি ফার্সিতে খোতবা দেন, হজরত
ইমাম আবু হানিফার দৃষ্টিতে তা বৈধ।' মুসলিম ধর্মতাত্তি্বকদের মধ্যে তিনি এমনই
উদারমনা ও প্রগতিপন্থী ছিলেন। হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁর জীবনের ৫২ বছর
উমাইয়া খিলাফতে এবং ১৮ বছর আব্বাসীয় খিলাফতে কাটান। মূলত তিনি মুসলিম
সামাজ্যের দুইটি বংশের তথাকথিত খেলাফত আমল স্বয়ং গভীরভাবে দেখার সুযোগ লাভ
করেন। উমাইয়া খেলাফতের জীবনকাল এবং তারপর সেই খিলাফতের পতন যুগও প্রত্যক্ষ
করেন। আব্বাসীয় খিলাফতের সেই যুগও তিনি দেখার সুযোগ পান, যখন পারস্য অঞ্চলে
অত্যন্ত সংগোপনে উমাইয়া শাসনের পতন ঘটানোর জন্য আন্দোলনের সূচনা লাভ করে। আর
সেই আন্দোলন উমাইয়া শাসকদের চোখের অন্তরালে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।
এভাবে আব্বাসীয়রা পরবর্তী সময়ে উমাইয়াদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিনিয়ে
নিতে সক্ষম হয়। আব্বাসীয়রা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটাত্দীয়ের কারণে সত্যিকার
অর্থে তাঁরাই খিলাফত তথা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী এই দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের
মধ্যে প্রচার করা হয়। কারবালা প্রান্তরে এজিদের হাতে রাসুল (সা.)-এর বংশধরদের
পরাজয়ের প্রতিশোধও এর প্রেরণা ছিল। হজরত ইমাম আবুহানিফা (রহ.) এসব রাজনৈতিক
অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হননি এবং তিনি এসব আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে
বিরত ছিলেন। উমাইয়া শাসকদের প্রতি তাঁর কোনো সমর্থন ছিল না এবং আন্দোলনকারী
নেতাদের সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
অত্যন্ত স্পর্শকাতর মনের মানুষ ছিলেন। কারো কোনো দুঃখ-কষ্ট দেখলে ভেতর থেকেই
তিনি উতলা হয়ে উঠতেন। একবার তিনি মসজিদে দরস দিচ্ছিলেন, কেউ একজন এসে বলল,
অমুকে দালানের ওপর থেকে পড়ে গেছে। এ কথা শুনে তিনি এত জোরে আর্তচিৎকার করলেন
যে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেল। তিনি হন্তদন্ত খালি পায়েই ছুটলেন সেই লোকের
বাড়ির দিকে। এমন উন্নততর হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তিনি। অথচ নিজের ওপর কোনো বিপদ
এলে তা নীরবে একা একাই সয়ে যেতেন। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী ও তার পাইক-পেয়াদা
কতভাবে কত রকম তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, যার হিসাব নেই। কিন্তু তারা কোনোভাবেই তাঁর
মাথা নত করতে পারেনি। উমাইয়া বা আব্বাসিয়া কোনো বংশের স্বৈরাচারী শাসকরাই
পারেননি তাঁকে তাঁদের দরবারি মোল্লা বানাতে। তিনি জগৎবাসীর জন্য ইসলাম ধর্মের
মহান শিক্ষার রূপরেখা উপহার দিয়ে গেছেন।।
রব্বে কারিম তাঁকে জান্নাতের উচ্চ আসনে সমাসীন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।।
.
.
মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবীবি
খতীবঃ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় কাশিপুর বড় মসজিদ, নারায়ণগঞ্জ।
szarif786@gmail.com
01914555679
No comments:
Post a Comment