মো জা ফ ফ র হো সে ন
মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে যে অর্থবোধক ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে সে ধ্বনিসমষ্টির নামই ভাষা। মানুষ কিভাবে ভাষা ব্যবহার করতে শিখেছে এবং কিভাবে ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণায় ওঠে এসেছে যে, পৃথিবীতে মানুষের আর্বিভাব যত পূর্বকালের ভাষার সৃষ্টি তত পূর্বকালের নয়। অর্থাৎ ভাষা আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষ আবির্ভাবের বহুকাল পরে। গবেষকদের ধারণা প্রাচীন মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত বিভিন্ন উপায়ে যেমন- ইশারা বা সঙ্কেত, অর্থহীন অস্ফুট ধ্বনি, নানা রকম রেখা, নকশা ও চিত্র অঙ্কনের দ্বারা। বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ম্যাক্সমুলারের মতে, ইশারা-ইঙ্গিতের পরই এসেছিল মুখের ভাষা। ভাষা কিভাবে সৃষ্টি হলো সে ব্যাপারে যেসব থিওরির অবতারণা করা হয়েছে তাতে কোনোভাবেই ভাষার জন্মকথা পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। The Bow-Wow Theory মতে জীবজন্তুর ডাক অনুকরণ করা থেকে ভাষার সূচনা। The Pooh- Pooh Theory বলছে মানুষ আঘাত অনুভব করতে পারত এবং সেই আঘাত প্রাপ্তের ধ্বনি থেকেই ভাষার জন্ম। ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে Ding-Dong Theory তে বলা হয়েছে স্পর্শকাতর মনের বহিঃপ্রকাশ থেকে ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীন মানুষ চোখের সামনে এক একটি বস্তু দেখে বিচিত্র শব্দ করেছে আর সেসব শব্দ থেকেই ভাষার জন্ম। Yo-he-ho Theory-এর ধারণা; মানুষ তার মনের অবসাদ দূর করার জন্য এক ধরনের শব্দ করে থাকে যেমন- কুলি-মজুরের শব্দ ‘হেইয়ো’, হুঁ হুঁ; এ থেকেও ভাষার উৎপত্তি হতে পারে। আবার Ta- ta Theory মতে মানুষ হাততালি বাজাতে গিয়ে ‘তা তা’, ‘তাই তাই’ শব্দ করতে পারে; এভাবেও ভাষার জন্ম হতে পারে। ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে এসব থিওরির ধারাবাহিকতা কিংবা যোগসূত্র শেষাবধি টিকে থাকতে পারেনি বলেই ভাষাবিজ্ঞানীরা এখন বলছেন; ভাষার উৎপত্তির সঠিক তথ্য এখন আর পুনর্গঠন করা সম্ভব নয়। তবে ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে একটি উৎস অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য পেশ করে এবং সেই বক্তব্যে ভাষার ইতিহাস এবং তার ধারাবাহিকতা ও যোগসূত্রের প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। উৎসটি হচ্ছে পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআন। ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে এই গ্রন্থের সূরা রহমানে বলা হয়েছে- ‘তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন’ [ আয়াত : ২, ৩]। পবিত্র কুরআনের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে- ‘হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও’ [সূরা হুজরত : ১৩]। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে মানুষ যখন পৃথিবীতে এসেছে তখন কথা বলার যোগ্যতা নিয়েই পৃথিবীতে পদার্পণ করেছে। কাজেই পৃথিবীতে আগে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে এবং পরে সেই মানুষ বিভিন্ন উপায়ে ভাষা শিখেছে এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য কি না তা ভাববার অবকাশ রয়েছে। পৃথিবীতে যে দু’জন মানুষ (আদম আ: ও হাওয়া আ:) প্রথম এসেছেন তাঁদের থেকেই ধ্বনি তারতম্যে বিভিন্ন ভাষার (প্রায় সাড়ে চার হাজার) জন্ম হয়েছে বলা যেতে পারে। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানও দেখিয়েছেন পৃথিবীর ভাষাগুলো মূল ভাষাগোষ্ঠী ইন্দো-ইউরোপীয় দলভুক্ত। পৃথিবীর প্রধান প্রধান ২০-২২টি ভাষা এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। কুরআনের তথ্য থেকে অনুমান করা যেতে পারে পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলো একটি ভাষা থেকেই সময়ের ব্যবধানে উচ্চারণ তারতম্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপলাভ করে থাকতে পারে। কুরআনের তথ্য মতে পৃথিবীর আদি মানব-মানবী ‘আদম-হাওয়া আ:’ এবং তাঁদের ভাষা ছিল আরবি। কুরআনে উল্লিখিত তথ্যকে সামনে রেখে ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে নতুন করে গবেষণা হওয়া জরুরি হতে পারে।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলা ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর দু’টি শাখা হলো ‘কেন্তুম্’ ও ‘শতম’। শতম্ এর কয়েকটি শাখা রয়েছে; তার মধ্যে ইন্দো-ইরানীয় একটি শাখা। এই ইন্দো-ইরানীয়র দু’টি শাখার মধ্যে একটি হলো ভারতীয় শাখা। ভারতীয় ভাষার দু’টি শাখার মধ্যে একটির নাম প্রাকৃত। এই প্রাকৃত ভাষা আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত; এর মধ্যে মাগধি একটি শাখা। এই মাগধি কয়েকটি শাখায় বিভক্ত যেমন- ওড়িয়া, অসমিয়া, বিহারি, বাংলা। অর্থাৎ ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। সেখান থেকে প্রাকৃত, মাগধি হয়ে বাংলা ভাষার জন্ম। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে চর্যাগিতিকায়। চর্যাগিতিকা যে ভাষাতে লেখা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সে ভাষাকে বাংলা বলেছেন এবং এ মন্তব্য প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লহ প্রমাণ করেছেন চর্যাগিতিকাগুলোর ভাষা ৬৫০ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যকার ভাষা। এ সময়ের আগে বাংলা ভাষার ধ্বনিরূপ কেমন ছিল তার লিখিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। নিশ্চয় এ সময়ের আগেও বাংলা ভাষা প্রচলিত ছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আধুনিক বাংলা ভাষার একটি বাক্যকে রূপান্তরের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছেন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী পর্যন্ত বাংলা ভাষার রূপটি কোন কোন সময় কেমন ছিল। ‘তুমি ঘোড়া দেখ’ আধুনিক বাংলা ভাষার এ বাক্যটিকে শহীদুল্লাহ সাহেব রূপান্তরিত করেছেন মধ্যযুগের বাংলায় এভাবে ‘তুম্হি ঘোড়া দেখহ’ (১৩৫০-১৮০০ খ্রি:)। প্রাচীন বাংলায় ‘তুম্হে ঘোড়া দেখহ’ (৬৫০-১২০০ খ্রি:)। প্রাকৃতে ‘তুম্হে ঘোটকং দেকখধ’ (৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব-২০০ খ্রি:) প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষায় ‘য়ুয়মশ্বং স্পশ্যথ’ (১২০০-৮০০ খ্রিষ্টপূর্ব)। আর ইন্দো-ইউরোপীয় রূপ হচ্ছে ‘য়ুস্ এক্ক্যোম্ স্পেক্যিএথে’ (৩৫০০-২৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব)। ‘তুমি ঘোড়া দেখ’ বাক্যটির বিভিন্ন সময়ের রূপান্তরিত রূপগুলো লক্ষ করলে অনুধাবন করা সহজ হয় যে, বাংলা ভাষা জন্ম থেকে আজোবধি একই রূপে প্রবাহিত হতে পারেনি। মাত্র চৌদ্দ শ’ বছর আগে বাংলা ভাষায় রচিত চর্যাগিতিকাগুলো সাধারণ বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য পাঠ করে বুঝে ওঠা আজকাল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা এতটা বদলেছে যে এ ভাষার পূর্বের শব্দরূপগুলোকে এখন বাংলা ভাষা বলে মনে করতে গিয়ে আশঙ্কা করতে হয়। যেমন- চর্যাগিতিকার ৭ নম্বর পদ ‘আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা/তা দেখি কাহ্ন বিমণা ভইলা’। চর্যাগিতিকার এই চরণটি সাধারণ বাংলা ভাষাভাষিদের নিকট এখন বুঝে ওঠা কষ্টকর হয়ে ওঠে। চরণটি আধুনিক বাংলাতে রূপান্তর করলে অর্থ দাঁড়াবে ‘আলি কালি দ্বারা রুদ্ধ হলো পথ। কানু তা দেখে দুঃখিত হলো।’ মধ্যযুগের বাংলা ভাষার লিখিত প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’। কাব্যটি চর্যাগিতিকার অনেক পরে রচিত বলে এ কাব্যের ভাষা চর্যাগিতিকা থেকে আলাদা। যেমন- ‘অঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী/বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী’ (অর্থ : অঝোরধারায় ঝরছে আমার নয়নের জল/বড়াই বাঁশির সুরে আমার প্রাণ হারালাম)। সাহিত্যের ভাষা যেভাবে কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে হয়ে এসেছে তেমনি ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দ এবং ধ্বনিও ভিন্নরূপ গ্রহণ করেছে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বাংলা ভাষা পর্যন্ত শব্দের বিবর্তন লক্ষ করলে বুঝতে পারা অতি সহজ হতে পারে। যেমন- ‘তিসি’, এ শব্দটি এখন আধুনিক বাংলা ভাষার শব্দ। শব্দটি প্রাচীন বাংলার মানুষ উচ্চারণ করত ‘তসী’ রূপে। এই তসী আরো পূর্বে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষায় প্রচলিত ছিল ‘অতসী’ রূপে। আবার ‘ঘি’ আধুনিক বাংলা। প্রাচীন বাংলাতে উচ্চারণ হতো ‘ঘিঅ’; তার আগে ‘ঘত’; তারও আগে ‘ঘৃত’। অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানে বাংলা ভাষার শব্দগুলো বিবর্তিত হয়েছে। এ ছাড়া ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার শব্দ হু হু করে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করছে। হিন্দি সিনেমা ও তার গান বাংলা ভাষাভাষি ছেলেমেয়েদের কাছে এখন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারাতে আনন্দ অনুভব করছে। ইংরেজি ভাষার শব্দগুলোকে বাংলা ভাষার বর্ণে লেখা হচ্ছে। বাংলা ভাষাভাষি কিছু ছেলেমেয়ে ইংরেজি মাধ্যমের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা পর্যন্ত করছে। এসবের প্রভাব বাংলা ভাষার ওপর পড়ার কারণে ভাষা তার সঠিক গতিপথ থেকে বিচ্যুত হতে পারে। যেভাবে এ দেশের তরুণ ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দি গানের চর্চা করে চলছে সে চর্চা প্রতিরোধ করতে না পারলে তা বাংলা ভাষার জন্য সুখকর হতে পারে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। কেননা গান, কবিতা, নাটক, সিনেমা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা চর্চা করা হয়ে থাকে।
বাংলা ভাষাকে বিবর্তন থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। সে চেষ্টা কতটা সফল হবে সেটি সময় বলে দেবে। তবে আজ থেকে এক হাজার বছর পরে হয়তো এখন যে শব্দটি যেভাবে উচ্চারণ করছি, বানান করছি, লিখছি, সেটি সেভাবে না-ও থাকতে পারে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা তার রূপ বদলিয়ে এক হাজার বছর পরে (এখন যে রূপ ব্যবহৃত হচ্ছে তার আর থাকবে না) অন্য রূপে প্রকাশিত হতে থাকবে। কেননা বাংলা ভাষারও উপভাষা রয়েছে। যেমন চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থায়ী সাধারণ মানুষ এক ধরনের বাংলা ভাষায় কথা বলে (প্রমিত বাংলা নয়) আবার সিলেট অঞ্চলের মানুষ আর এক ধরনের বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। এ দিকে রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষ অন্য একধরনের বাংলায় কথা বলে এবং রাজশাহী অঞ্চলের বাংলা ভাষা আর এক ধরনের। এই যে ভিন্ন ভিন্নœ অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন উপভাষা। এই উপভাষার উচ্চারণ ধ্বনিগুলো বাংলা ভাষাকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। সে জন্য নাটক সিনেমার সংলাপে যত কম উপভাষা ব্যহার করা যায় ততই মূল ভাষার জন্য মঙ্গল হতে পারে।
নাটক, সিনেমা ও সাহিত্যের মধ্যে বেশি বেশি উপভাষা ব্যবহার করা হলে সে উপভাষাগুলোর মধ্যে কোন উপভাষাটাকে বাংলা ভাষা বলা হবে? নাকি কোনোটাই বাংলা ভাষা নয়? নাকি সবগুলোই বাংলা ভাষা? এ রকম প্রশ্ন থেকে যেতে পারে। এ জন্য বাংলা ভাষাকে প্রমাণস্বরূপ করে প্রমিত বাংলা করা হয়েছে যেন ভাষাকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে সহজেই চিহ্নিত করা যায় যে, এটি বাংলা ভাষা। তা না হলে বাংলা উপভাষার প্রভাবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে।
No comments:
Post a Comment