Latest Post

কওমীর স্বীকৃতি ও দেবিমূর্তি বিরোধী বক্তব্য আর রাজনৈতিক স্বার্থের ভেল্কিবাজি: মুহাম্মাদ মামুনুল হক

ঢাকা ১৩ই এপ্রিল'১৭ আজকের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনাম দেখে মনে পড়ছে দুই হাজার ছয়ের কথা ৷ যখন হযরত শায়খুল হাদীস রহঃএর দলের...

Thursday, February 23, 2017

মানুষের সাথে কোমল ব্যবহার ও হাসিমুখে মেলামেশা করা

রবির কিরণে উদ্ভাসিত হয়ে চাঁদ জোৎস্না ছড়ায়। স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে হেসে ওঠে ধরণী, মানব হৃদয়ে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। নিস্পন্দ জোৎস্না প্লাবিত রজনী ধরণীর শিয়রে জেগে থেকে চুপি চুপি ভাবের তরঙ্গ জাগিয়ে তোলে মানব হৃদয়ের শান্ত সরোবরে। একই ভাবে আল্লাহর দেয়া ‘রিফক’র আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে মানুষ তার উত্তম আখলাক ছড়িয়ে পরিবার সমাজকে অলোকিত করে, সুখময় করে গড়ে তোলে। এমন সুন্দর চরিত্রের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় নবী জীবনে। তাই সুখী পরিবার ও সমাজ গঠনের প্রয়োজনে নবী জীবনের আদর্শকে আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। নবী জীবন কেমন ছিল, তার পরিচয় মেলে নিম্নোক্ত হাদিস খানাতে।
আতা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর বিন আস (রাঃ) -এর সাথে সাক্ষাৎ করে বললাম : তওরাতে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (সঃ)-এর বিশেষণসমূহ সম্পর্কে আমাকে অবগত করুন। তখন তিনি বললেন: হ্যাঁ, (তাই হবে) নিঃসন্দেহে তওরাতে রসুলুল্লাহ (সঃ)-কে এমন কতিপয় বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে -যা দ্বারা কোরআন শরীফে তিনি বিশেষিত হয়েছেন। ঃ “ হে নবী আমি আপনাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছি। ” (আহযাব- ৪৫)
এবং ‘নিরক্ষরদের স্মরণ  স্থল ’, ‘আপনি আমার দাস ও আমার পয়গাম বাহী রসুল ’, আমি আপনার নাম করণ করেছি ‘মুতাওয়াক্কিল’- আল্লাহ্তে নির্ভরশীল।  রুক্ষ মেজাজ, দুর্মুখ বা হাট বাজারে শোরগোল কারী নন, দুর্ব্যবহারের দ্বারা দুর্ব্যবহারের জবাব দেন না, বরং মার্জনা ও ক্ষমা করে দেন। (আল- আদবুল মুফরদ- ২৪৬ঃ১)
রাবী আতা ইবনে ইয়াসার আসল নাম আবু মোহাম্মাদ আল হিলালী আল মাদানী। তিনি ছিলেন উম্মুল মুমিনীন মাইমুনা (রাঃ)’র মুক্তদাস তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য রাবী (সিকাহ)। তিনি ৯৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।  তিনি যায়েদ ইবনে সাবেত, আবু আইউব ইবনে মাসউদ, আবু দারদা, হযরত আয়েশা (রাঃ), উসামা ইবনে যায়েদ আবু হোরায়রার সূত্রে এবং যায়েদ ইবনে আসলাম, আমর ইবনে দীনার ও আরও অনেকে তাঁর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেন।
 রসুল (সঃ) ছিলেন জ্যোতিষ্মান প্রদীপ বিশেষ। তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে এক আরব কবি বলেনঃ
ইয়া সাহিবাল জামালি ইয়া সাইয়্যিদাল বাশার
বি- ওয়াজহিকাল মুনিরি লাক্বাদ নাওয়ারাল কামার
হে জ্যোতির্ময়, হে মানব শ্রেষ্ঠ, তোমার পূত চেহারার দীপ্তি থেকেই চাঁদ আলোক প্রাপ্ত হয়েছে।
যার হৃদয় যত পবিত্র কলুষ মুক্ত তিনি হতে পারেন তত কোমল ব্যবহারের অধিকারী, সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা অধিকারী। রসুল সঃ)-এর চেয়ে পবিত্র মনের অধিকারী ধরণীতে কোন ব্যক্তির আগমন ঘটেনি তাই তার চেয়ে আকর্ষণীয় আচরণের অধিকারীও কেউ ধরাধামে আগমন করেনি, ভবিষ্যতেও করবেন ন॥
নবী করীম (সঃ) সব সময় হাসি মুখে থাকতেন, সঙ্গী সাথীদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়া মাত্র হাসিমুখে অভ্যর্থনা করতেন; কিন্তু জীবনে কেউ কোনদিন তাঁকে অট্টহাসি হাসতে দেখেনি। প্রবল হাসির উদ্রেক হলে কখনও কখনও  বিদ্যুৎ চমকের মত একফালি দাঁতের ঔজ্জ্বল্য ফুটে বের হত। সাহাবী জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন, জীবনে যতবার আমি রসুলে পাকের (সঃ) সাথে সাক্ষাত করেছি, ‘ প্রত্যেক বারই তিনি আমাকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করেছেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার কথা শুনেছেন।’ “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারিস (রাঃ) বলেছেনঃ  মা কানা দেহ্কা রসুলিল্লাহে (সঃ) ইল্লা তাবাস্ সুমা- নূরনবী (সঃ) মৃদু হাসি ব্যতিত কখনও উচ্চ হাস্য করতেন না।
পবিত্র আখলাকের সৌন্দর্য দ্বারা মানুষের প্রেম প্রীতি ও সম্মান হাসিল করা যায়। গোমরামুখী হওয়া কোন তাকওয়ার পরিচয় বহন করে না। ব্যক্তিগত জীবনে দেখা যায় অনেক সৎ চরিত্রের অধিকারীদের চরিত্রে কোমলতা কম থাকে, মেজাজ থাকে কিছুটা কর্কশ। মুমিনের এমন চরিত্র হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিয়ামতের দিন এমন লোককেও আল্লাহর সামনে হাযির করা হবে যার আমল নামার মধ্যে নামায, রোযা, যাকাত প্রভৃতি নেক আমল থাকবে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি তার মন্দ আচরণের জন্য আল্লাহর কাছে নালিশ করবে। তাই মিষ্টি হাসি, মধুর আচরণ ও কোমল চিত্তের অধিকারী হওয়া পরিবার প্রধান  সমাজ সংস্কারকদের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হওয়া প্রয়োজন।
রসুল (সঃ) ছিলেন এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কোরআন সাক্ষ্য দেয়ঃ ফাবিমা রহমাাতিম্ মিনাল্লাহে লিন্তা লাহুম ওয়া লাও কুনতা ফাজ্জান্ গালিজাল কালবে লান্ফাদ্দু মিন হাওলিকা- অল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের জন্য কোমল। হে মুহাম্মাদ! আর যদি তুমি কঠোর হৃদয় হতে তা হলে অবশ্য তারা তোমার পাশ থেকে সরে দাঁড়াত। ( আলে ইমরান-১৭০)
মধুর চরিত্রের অধিকারী ও মিষ্টভাষীদের জন্য জান্নাতের সুখবর রয়েছে পবিত্র হাদিসে। আনাস রাঃ) থেকে বর্ণিত : রসুলল্লাহ (সঃ) বলেছেন-  যে কথাটি প্রকৃতই মিথ্যা এবং অসঙ্গত, যে ব্যক্তি উহা বলা এবং উহা আলোচনা করা পরিত্যাগ করে, তার জন্য জান্নাতের কিনারায় স্থান নির্মিত হয়। যে ব্যক্তি সঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া বিবাদ পরিত্যাগ করে, তার জন্য জান্নাতের মধ্যে বাসস্থান নির্মিত হয়।  যে ব্যক্তি বাক সংযম, মিষ্টভাষণ এবং সত্য কথার প্রভৃতি সকল গুণ দ্বারা নিজের চরিত্র সৌন্দর্যমন্ডিত করে, তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে বাসস্থান নির্মিত হয়। ( মেশকাত)
যে জীবনে আনন্দ রস একবারেই নেই, সাধারণ মানুষ তেমন জীবনকে আদর্শরূপে গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু হাসি তামাশা যেন ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে না যায় সে জন্য সূক্ষ্ম রস বোধ ও আত্ম সংযম থাকা দরকার। নবী জীবনের হাসি তামাশার দিকটায় এই সত্যের প্রতি আলোক পাত করা হয়েছে। হয়রত আয়েশা (রাঃ) সাক্ষ্য দেনঃ রসুলুল্লাহ (সঃ) কাউকে অভিশাপ দিতে কারো নিন্দা করতে বা কারো সঙ্গে কর্কশ ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিলেন না।
‘নীরবতা, নির্জনতা, স্থির ও সমাজ বিচ্ছিন্ন একক জীবন ইসলাম নয়।’ তাই দেখা যায় রসুল (সঃ)-এর পারিবারিক জীবন ছিল, জীবনে হাসি তামাশা ছিল, ছিল তাঁর জীবনে তুলনা বিহীন কোমল ব্যবহার । এই কোমল ব্যবহারের গুণটি আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত রূপে। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সঃ) বলেছেনঃ “কোন গৃহের কল্যাণ করার উদ্দেশ্য ছাড়া আল্লাহ তাদেরকে ‘রিফক’ দান করার ইচ্ছা করেন না এবং তাদের ক্ষতি করা ছাড়া তাদেরকে ‘রিফক’ থেকে বঞ্চিত করেন না। ”
হাদিসে ব্যবহৃত ‘রিফক’ শব্দের অর্খ ব্যাপক। শুধুমাত্র দয়া বা নম্রতা  কিংবা নরম মেজাজ দ্বারা অর্থ প্রকাশ করে শেষ করা যায় না। তাই পরিবার ও সমাজের কল্যাণ কামনায় আল্লাহর কাছে ‘রিফ্ক’র মোহতাজ হয়ে তা লাভের জন্য আবেদন করতে হবে।
এই রিফ্কের গুণে গুণান্বিত হয়ে পরিবারের সাথে, প্রতিবেশীর সাথে, সমাজের সমস্ত মানুষের সাথে হাসি মুখে, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে তাদের সাথে মিলতে হবে, কোমল আচরণ করতে হবে।এ সব যেন লোক দেখানোর না হয়। এ কথা সবার জানা, স্নেহ যত গোপনের, যত নির্জনের হয় ততই প্রবল হতে থাকে। তাই হৃদয়ের গোপন আস্তানা থেকে ভালবাসতে হবে, ভাল ব্যবহার করতে হবে। তা হলে আশা করা যায় পরিবার ও সমাজ সংশোধনের কাজ আঞ্জাম দেয়া অনেকটা সহজ হবে।
মানুষের সাথে প্রতিবেশীর সাথে সুন্দর আচরণ করা ঈমানের অন্যতম শিক্ষা। তাই সর্বাবস্থায় সর্ব স্তরের মানুষের সাথে ভদ্র আচরণ করা ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য।

No comments:

Post a Comment